যারা বিশ্বাস করেন ‘আমটি পাকিলেই গাছ হইতে ঝরিয়া পড়িবে’; তারা স্বপ্ন দেখতে জানেন না। জানলেও স্বপ্নকে সাকার রূপ দিতে পারেন না। ফলটি পাকার আগেও পেড়ে আনা যায়। সে জন্য ঝড় দরকার। তেমনই এক ‘ঝড়’ উঠেছিল উনবিংশ শতকের প্রথমভাগে। সর্বহারার মহান শিক্ষক কার্ল মার্কস আর তার যোগ্য পণ্ডিত ফেডারিক এঙ্গেলস যে মানবমুক্তির দিশা দিয়েছিলেন বছরের পর বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে, তারই নির্যাস হয়ে মানব সভ্যতা পেয়েছিল ‘কমিউনিস্ট পার্টির ইসতেহার’, ‘ডাস ক্যাপিটাল’ প্রমূখ গ্রন্থ। মহামতি ভ.ই.লেনিন মার্কসের সেই অধরা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক বলশেভিক বিপ্লব সম্পন্ন করে পৃথিবীর বুকে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘সোভিয়েত ইউনিয়ন’ গঠন করে। পথটি মসৃণ ছিল না। লাখ লাখ মানুষের অকাতরে বিলিয়ে দেওয়ার রক্তের নদী বেয়ে এসেছিল। সারা বিশ্ব প্লাবিত হয়েছিল সেই মানবমুক্তির জোয়ারে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে জোয়ার দুভাবে আসে; এক. ইতিবাচকভাবে, যা সৃষ্টি করে। দুই. নেকিবাচকভাবে; যা ধ্বংস করে। বলশেভিক বিপ্লবের পর পরই সারা বিশ্ব মুক্তির জোয়ার প্লাবিত হয়েছিল। সেই প্লাবনে ইয়োরোপ, এশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকার দেশে দেশে সমাজতন্ত্রে বিজয় সুনিশ্চিত হয়েছিল। আরও একটি ‘ঝড়’ উঠেছিল গত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে। হিটলারের নাৎসি বাহিনী যখন গোটা বিশ্বকে পরাভূত করে পদানত করতে চলেছে, সেই সময় সোভিয়ের ইউনিয়নের জনগণের নেতা তথা বিশ্বনেতা জোসেফ স্তালিনের দৃঢ়তায় এবং বীরত্বে দানব হিটলারকে থামতে হয়। হাত গুটিয়ে নেয় পরাজিত নাৎসি দল। স্তালিনের সেই বিজয়ের প্লাবন আরও একবার বিশ্বকে প্লাবিত করে। ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত তথা বিশ্বমানবতার জয় হলে বিভিন্ন মহাদেশে সামন্তবাদী-পুঁজিবাদী বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলো ভাঙতে থাকে। দিকে দিকে পত পত উড়তে শুরু করে সমাজতন্ত্রের লাল পতাকা। বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ মানুষই তখন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিক। এর পরের ‘ঝড়’টি আসে নেতিবাচক রূপে। সমাজতন্ত্রের দুশমন, সোভিয়েতের আদর্শ হন্তারক কুখ্যাত ক্রুশ্চেভের হাত ধরে। যার যবনিকা টানেন তারই অপভ্রংশ নিকৃষ্টতম পুঁজিবাদের দালাল মিখাইল গর্বাচেভ-এর হাতে। ১৯৯১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটান গর্বাচেভ। আর সেই নেতিবাচক জোয়ারে খুব দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যারা এক সময় সমাজতন্ত্রের পতাকা উড়িয়ে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ মুছে দিতে চেয়েছিল, সেই তারাই আবার ব্যক্তিস্বার্থে এবং তথাকথিত উন্নয়নের শ্যাম্পেন গিলে পুঁজিবাদের দাসত্ব মেনে নেয়। সেই নেতিবাচক জোয়ারে দেশের পর দেশ প্লাবিত হতে থাকে আর মুক্তিকামী মানুষ আরও বেশি করে শৃঙ্খলিত হতে থাকে। মানুষ মার্কসের সেই বিখ্যাত উক্তিগুলো মনে মনে আউড়ায়-‘শৃঙ্খল ছাড়া সর্বহারার হারাবার কিছু নাই, জয় করবার জন্য রয়েছে গোটা বিশ্বটাই’, কিংবা-‘আজকের দিনে বুর্জোয়া শ্রেণির মুখোমুখি যে সব শ্রেণি দাঁড়িয়ে আছে তাদের মধ্যে শুধু প্রলেতারিয়েতই প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণি। প্রত্যেক দেশের প্রলেতারিয়েতকে অবশ্যই সর্বাগ্রে হিসাব মেটাতে হবে নিজেদের দেশের বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে।’ তারপরও স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। পৃথিবীজুড়ে পুঁজিবাদী শাপদেরা দাঁপিয়ে বেড়ায়। লেনিন, স্তালিন, মাও সেতুং, চারু মজুমদার মারা গেছেন। পৃথিবী নেতৃত্বশূন্য। কোথাও কোনও আশার আলো নেই। সাম্রাজ্যবাদী একচেটিয়া আগ্রাসী পুঁজি গোটা বিশ্বকে গ্রাস করে চলেছে...। হতাশায় নিমজ্জিত মানুষ অক্ষমতার আবর্তে কেবল স্বপ্নই দেখে-মাও সেতুং স্বপ্ন দেখান-‘বিপ্লবী যুদ্ধ হচ্ছে জনসাধারণের যুদ্ধ, কেবলমাত্র জনসাধারণকে সমাবেশ করে এবং তাঁদের উপর নির্ভর করেই এ যুদ্ধকে চালিয়ে নেয়া যেতে পারে।’ মার্কস মনে করিয়ে দেন-‘যে অস্ত্রে বুর্জোয়া শ্রেণি সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধূলিস্মাৎ করেছিল সেই অস্ত্র আজ বুর্জোয়া শ্রেণির নিজেরই বিরুদ্ধে উদ্যত, যাতে বুর্জোয়া শ্রেণির মৃত্যুবাণ রয়েছে।’ তবুও মানুষ জেগে ওঠে না! আবারও মাও মনে করিয়ে দেন-‘বিপ্লব কোনো ভোজসভা নয়, বা প্রবন্ধ রচনা কিংবা চিত্র অংকন অথবা সূচিকর্মও নয়। এটি এত সুমার্জিত, এত ধীর-স্থির ও সুশীল, এত নম্র, এত দয়ালু, বিনীত, সংযত ও উদার হতে পারে না। বিপ্লব হচ্ছে একটি অভ্যুত্থান-উগ্রপন্থী প্রয়োগের কাজ, যার দ্বারা এক শোষিত শ্রেণি, অন্য শোষক শ্রেণিকে উত্খাৎ করে।’ বিশ্ব পরিসরে ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া আছে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী নিয়মে থাকতেই হয়। তাই বিশ্বের দেশে দেশে শোষণ-নিপীড়ন যতো বাড়ে ঠিক সেই অনুপাতে মানুষের ভেতরেও মুক্তির আকাঙ্খা বাড়ে। বাড়তেই হয়। সেভাবেই একবিংশ শতকের শুরু থেকেই দেশে দেশে সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখা মানুষ জাগতে শুরু করেছে। কেননা সভাপতি মাও সেতুং বলে গেছেন- ‘যদি বিপ্লব করতে হয়, তাহলে অবশ্যই একটা বিপ্লবী পার্টি থাকতে হবে। একটা বিপ্লবী পার্টি ছাড়া, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী বিপ্লবী তত্ত্বে এবং বিপ্লবী রীতিতে গড়ে উঠা একটা বিপ্লবী পার্টি ছাড়া, শ্রমিকশ্রেণি ও ব্যাপক জনসাধারণকে সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহি কুকুরদের পরাজিত করতে নেতৃত্বদান করা অসম্ভব। সারা দুনিয়ার বিপ্লবী শক্তি এক হও, সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করো।’ মার্কস-লেনিন-স্তালিন-মাও এর মত কমরেড চারু মজুমদারও বললেন-‘যে স্বপ্ন দেখে না, সে অন্যকেও স্বপ্ন দেখাতে পারে না।’ আর তাই শ্রমিক-কুষক-সর্বহারার মুক্তির যুদ্ধকে সৌজন্যবাদের চোরাবালিতে হারাতে না দেওয়ার জন্য বললেন-‘লেনিনকে না মেনে যারা মার্কসবাদী হতে চেয়েছিল তারা ইতিহাসের আবর্জনাস্তুপে আশ্রয় নিয়েছে। তেমনি আজকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বোচ্চরুপ মাও সেতুঙের চিন্তাধারা-এই আন্তর্জাতিক মার্কসবাদী কর্তৃত্বের যারা বিরোধিতা করছে, তাদেরও আশ্রয় নিতে হবে সাম্রাজ্যবাদের কোলে।’ হয়তো ঠিক এভাবে নয়, একটু ভিন্ন পথে ফের পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র ফিরে আসছে। এটা যে আসবে তা মার্কস-এঙ্গেলস বহু বছর আগেই বলে গেছেন। দ্বন্দ্বের নিয়ম হলো ‘এক ভেঙে দুই হওয়া’। এই সূত্রে আজকে যখন একটি দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে হলেও সমাজতন্ত্র কায়েম হচ্ছে বা নিদেনপক্ষে বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় আসছে, যখন মৃদু জোয়ারে আরও অনেক দেশ প্লাবিত হতে চাইছে।
চারু মজুমদার বললেন “সরােজ দত্তের ক্ষুরধার লেখনীকে ভয় করত না এমন কোনাে প্রতিক্রিয়াশীল নাই” আর তাই তাে খুনি ইন্দিরার খুনি পুলিশ শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হলাে না ৭০ বছরের বিপ্লবীকে তার মাথা কেটে নিয়ে গেল ব্রেজনেভ নিক্সন-ইন্দিরা-চবনের ভাড়াটে নেড়ি কুকুরের দল। ওদের খাতায় সরােজ দত্তকে নিখোজ দেখাতে। কিন্তু সরােজ দত্ত তাে নিখোঁজ হলেন না। তিনি শহিদ হয়ে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে গেঁথে বসলেন বিপ্লবী শ্রমিক-কৃষকের হৃদয়ে । তাঁরই পদচিহ্ন বেয়ে এগিয়ে চলে যখন মহাদেব মুখার্জির নেতৃত্বে সিপিআই (এম-এল) কেন্দ্রীয় কমিটি যখন চারু মজুমদারকে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের বিপ্লবের কর্তৃত্ব হিসেবে ঘােষণা করল যা পরবর্তীতে ১৯৭৩ এর ডিসেম্বর এ অনুষ্ঠিত পার্টির দ্বিতীয় (নবম) কংগ্রেস এর মঞ্চ থেকে ঘােষিত হলাে কামান গর্জনের মতন এবং কামালপুরের মাটিতে শ্রেণি শত্রু খতম এক নয়া স্তরে উন্নীত হলাে তখন শাসকশ্রেণি ও তার কুকুরদের পাল লেজ গুটিয়ে পালাতে থাকল, চারু মজুমদারের কর্তৃত্ব শহিদের রক্তের ভিতে প্রতিষ্ঠিত এই সত্য প্রতিষ্ঠা হলাে এবং একে খণ্ডন করার কোনাে ক্ষমতাই আর শাসক শ্রেণি ও তার পেটোয়া রক্ষিতাদের রইল না।