আদিপর্ব . যথাশক্তি সকলপ্রকার সর্পই বধ করতে লাগলেন। একদিন তিনি বনে গিয়ে দেখলেন এক বৃদ্ধ ডুণ্ডুভ (ঢোঁড়া সাপ) শুয়ে আছে। রুরু তখনই তাকে দণ্ডাঘাতে মারতে গেলেন। ডুণ্ডুভ বললে, তপোধন, আমি কোনও অপরাধ করি নি, তবে কেন আমাকে মারতে চান? রুরু বললেন, আমার প্রাণসমা ভার্যাকে সাপে কামড়েছিল, সেজন্য প্রতিজ্ঞা করেছি সাপ দেখলেই মারব। ডুণ্ডুভ বললে, যারা মানুষকে দংশন করে তারা অন্যজাতীয়, আপনি ধর্মজ্ঞ হয়ে ডুণ্ডুভ বধ করতে পারেন না। রুরু জিজ্ঞাসা করলেন, ডুণ্ডুভ, তুমি কে? ডুণ্ডুভ উত্তর দিলে, পূর্বে আমি সহস্রপাৎ নামে ঋষি ছিলাম। খগম নামে এক ব্রাহ্মণ আমার সখা ছিলেন, তাঁর বাক্য অব্যর্থ। একদিন তিনি অগ্নিহোত্রে নিযুক্ত ছিলেন সেই সময়ে আমি বালসুলভ খেলার ছলে একটি তৃণনির্মিত সর্প নিয়ে ভয় দেখিয়েছিলাম, তাতে তিনি মূর্ছিত হন। সংজ্ঞালাভ ক'রে তিনি সক্রোধে বললেন, আমাকে ভয় দেখবার জন্য তুমি যেমন নির্বিষ সৰ্প নির্মাণ করেছ, আমার শাপে তুমিও সেইরূপ হবে। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে কৃতাঞ্জলি- পুটে তাঁকে বললাম, আমি আপনাকে সখা জ্ঞান ক'রে এই পরিহাস করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন, শাপ প্রত্যাহার করুন। খগম বললেন, যা বলেছি তা মিথ্যা হবে না, তবে আমার এই কথা শুনে রাখ—প্রমতির পুত্র রুরুর দর্শন পেলে তুমি শাপমুক্ত হবে। তুমি সেই রুরু, আজ আমি পূর্বরূপ ফিরে পাব ।
ছদ্মনাম পরশুরাম। জন্ম ১৮৮০ সালের ১৬ মার্চ, মঙ্গলবার। বর্ধমান জেলার শক্তিগড়ের সন্নিকটে বামুনপাড়া গ্রামে, মামা বাড়িতে। পৈত্রিক নিবাস নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী উলা বীরনগর। বাবার নাম চন্দ্রশেখর বসু। তিনি সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্রের অনুরাগী ছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। তাঁর রচিত বেদান্তদর্শন, বেদান্তপ্রবেশ, সৃষ্টি, অধিকারতত্ত্ব, প্রলয়তত্ত্ব প্রভৃতি গ্রন্থ সেকালে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বাবার সঙ্গে লেখকের বাল্যকাল কেটেছে বাংলার বাইরে। মুঙ্গের জেলার খড়্গাপুরে। ১৮৮৮ থেকে ১৮৯৫ পর্যন্ত দ্বারভাঙ্গার রাজ স্কুলে পড়াশোনা করেন। সেই স্কুল থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করেন। ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৭ পাটনা কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৮৯৭ সালে ভর্তি হন কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। ১৮৯১ সালে কেমিস্ট্রি ও ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে পাস করেন। ১৯০০ সালে রসায়ন শাস্ত্রে এম.এস.সি-তে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। বেঙ্গল কেমিকেল ওয়ার্কস-এ চাকরি শুরু করেন। ১৯০৩ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানে প্রভূত উন্নতি সাধন করে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সাহিত্যের উপর ছিল তাঁর প্রবল অনুরাগ। বিশেষ করে হাস্যরসাত্মক রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। বাংলা সাহিত্যে পরশুরাম ছদ্মনামে আত্মপ্রকাশ করেন এবং রম্য-রচনার মাধ্যমে পাঠকদের মন জয় করেন। হয়ে ওঠেন বাংলার হাস্যরসাত্মক রচনার শ্রেষ্ঠ লেখক। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রতিভার ভূয়ষী প্রশংসা করেছেন। উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি : কজলী, গড্ডালিকা, লঘুগুরু, নীলতারা, কৃষ্ণকলি, লম্বকর্ণ, ভূশুণ্ডীর মাঠ, হনুমানের স্বপ্ন, ভারতের খনিজ, গল্পকল্প প্রভৃতি। তাঁর রচিত চলন্তিকা অভিধান বাংলা ভাষা শিক্ষার্থীদের কাছে অমূল্য সম্পদ। অসামান্য সাহিত্য সৃষ্টির স্বীকৃতিস্বরূপ 'একাদেমী’, ‘রবীন্দ্রপুরষ্কার' সহ বহু পুরষ্কার পান। ভারত সরকার থেকে ‘পদ্মভূষণ’লাভ করেন। ১৯৬০ সালের ২৭ এপ্রিল রাজশেখর বসুর মৃত্যু হয়।