“রাইফেল রোটি আওরাত” বইয়ের ভূমিকা: মানুষ এবং পশুর মধ্যে বড় একটা পার্থক্য হচ্ছে, পশু একমাত্র বর্তমানকেই দেখে, মানুষ দেখে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে এক সঙ্গে বিবচেনা করে। যখন কোন ব্যক্তি এবং সমাজ একমাত্র বর্তমানের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে তখন সর্বনাশের ইশারা প্রকট হতে থাকে। বাঙালির সুদীর্ঘ ইতিহাসের বোধ করি সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় হচ্ছে তার সংগ্রামের কালগুলো। এবং এক্ষেত্রে উজ্জ্বলতম ঘটনা হচ্ছে, ১৯৭১-এ পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অসাধারণ লড়াই। এ ছিল সমগ্ৰ জাতির একতাবদ্ধ দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ সংগ্রাম। আমাদের পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য, আমাদের বর্তমানের গৌরব এবং আমাদের ভবিষ্যতের প্রেরণা বাঙালির এ সংগ্রামের ইতিহাস। অত্যন্ত শঙ্কিত চিত্তে লক্ষ্য করার মত ব্যাপার হচ্ছে, আমরা এটাকে যেন ভুলে যেতে বসেছি। যেসব লক্ষ্য নিয়ে আমাদের লড়াই তাকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যর্থতা থেকেই এ বিস্মৃতির সূত্রপাত হচ্ছে। কিন্তু ব্যৰ্থ বর্তমান তো কোন জাতিরই চিরকালের সত্য ইতিহাস নয়, সত্য অনুভূতিও নয়। যে আবেগ এবং অনুভূতি চক্রান্তের ধূর্তচক্রে আচ্ছন্ন হচ্ছে, তাকে উজ্জীবিত করার জন্যই দরকার সংগ্রামের কালের মানুষের মহান ত্যাগ এবং নিষ্ঠাকে বারংবার স্মরণ করা। তার থেকেই আসবে কুশায়াকে দূর করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা। আমাদের চিত্তের পবিত্ৰতা রক্ষা পাবে। সেকালের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্যে বসে লেখা আমাদের সমগ্র ইতিহাসে একটি মাত্র উপন্যাসই পাওয়া যায়-এ উপন্যাসই হচ্ছে “রাইফেল রোটি আওরাত"। ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে জুন মাস এর রচনাকাল। লেখক শহীদ আনোয়ার পাশা নিহত হলেন ১৯৭১ সালেরই ১৪ই ডিসেম্বর। স্বাধীনতা লাভের মাত্র দু'দিন আগে তিনি যে অমর কাহিনী উপন্যাসে বিধৃত করেছেন নিজেই হয়ে গেলেন তারই অঙ্গ চিরকালের জন্য। আনোয়ার পাশার উপন্যাসটি একদিক দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বসে একজনের প্রতিটি মুহুর্তের কাহিনী। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে সৃষ্ট এ শিল্পকর্ম কতটা সত্যনিষ্ঠা লেখকের জীবনের পরিণতিই তার মহান সাক্ষ্য হয়ে থাকবে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-জীবনে জীবন যোগ করা না হলে, কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা। আনোয়ার পাশার উপন্যাস, তাঁর শেষ উচ্চারণঃ “নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভা। সে আর কতো দূরে। বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।” তাঁর এবং আমাদের সকলের কামনা ও প্রত্যাশারই অভিব্যক্তি। শিল্পী তাঁর জীবনকে আমাদের জীবনের মধ্যে পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছেন। ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ আনোয়ার পাশার শহীদ আত্মার আকাঙক্ষাকেই যেন আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে চলেছে নিরন্তর এবং অম্লান। কাজী আবদুল মান্নান
শহীদ আনােয়ার পাশার জন্ম ১৯৩২ সালে। গ্রাম: ডাবকাই, মুর্শিদাবাদ জেলায়। তার পিতা হাজী মকরম আলী ও মাতা সাবেরা খাতুন। ১৯৫৩ সালে কলকাতা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কৃতিত্বের সাথে বাংলা সাহিত্যে এম.এ. পাশ করেন। ঐ বছরেই তিনি বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম মসিনা খাতুন। ১৯৫৮ সালে পাবনা জেলার এডওয়ার্ড কলেজে বাংলার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। পরে ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে যােগদান করেন এবং শহীদ হওয়ার আগ পর্যন্ত ঐ বিভাগেই অধ্যাপনা করে গেছেন। আনােয়ার পাশা ছিলেন কবি সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ। তার সাহিত্যকর্মে ফুটে ওঠে দেশাত্মবােধ. মননশীলতা, প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা।। তার উল্লেখযােগ্য সাহিত্যকর্ম নীড় সন্ধানী, নিশুতি রাতের গাথা, রাইফেল রােটি আওরাত, নদী নিঃশেষিত হলে, সমুদ্র শৃঙ্খলতা উজ্জয়িনী ও অন্যান্য কবিতা, সাহিত্য শিল্পী আবুল ফজল, রবীন্দ্র ছােটগল্প সমীক্ষা, নিরুপায় হরিনী। তার সাহিত্যকর্মের জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭২ মরনােত্তর) সম্মাননা পান।। ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার্স থেকে পাক-হানাদার বাহিনীর এদেশীয় সহযােগী আলবদরের সদস্যরা ধরে নিয়ে গিয়ে মিরপুর বধ্যভূমিতে হত্যা করে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর। তিনি স্ত্রী এবং দুই ছেলে রেখে গেছেন ।। ছেলেদের নাম মাসারুল আফতাব ও রবিউল আফতাব ।