ভূমিকা বাংলা বানান নিয়ে বিভ্রান্তি দিনে দিনে বাড়ছে। বানানের নিয়মকানুন যে প্রতিদিন বদলাচ্ছে তা নয়, বানান আয়ত্ত করার বিষয়ে আমাদের ঔদাসীন্য ও অবহেলা বাড়ছে, বাড়ছে এক ধরনের হঠকারিতাও । অনেকের অভিযোগ ,বাংলা বানান বড় কঠিন। সব ভাষার বানানই যত্ন করে শিখতে হয়। অনেকের পর্যবেক্ষণ, উচ্চারণের সঙ্গে বানানের মিল নেই বাংলায়। ভাগ্যিস নেই! আমরা প্রত্যেকে যদি নিজেদের উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লিখতাম, তাহলে কী ভয়ংকর পরিনামই না হতো! তাছাড়ও উচ্চারণ আর বানানের যোগ অনেক ভাষাতেই থাকে না । বার্নার্ড শ’র সেই বিখ্যাত উদাহারণের কথা অনেকরই জানা আছে: GHOTI-র উচ্চারণ FISH হবে না কেন, তার যোগ্য জবাব নেই। বাংলা ভাষার অধিকাংশ না হলেও এক বড় অংশ জুড়ে আছে তৎসম শব্দ। এসব শব্দ সরাসরি সংস্কৃত থেকে নেওয়া হলেও পুরোনো বাংলায় তার বানান সবসময়ে সংস্কৃতের অনুসরণ করে নি। তারপর বাংলা শব্দভাণ্ডারে আছে তদ্ভব,দেশি ও বিদেশী শব্দ। তদ্ভব শব্দের বানানেও এককালে লোকে ইচ্ছেমতো লিখেছেন। দেশি ও বিদেশী শব্দেও তেমনি শৃঙ্খলা ছিল না। সেই শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা হলো ঊনিশ শতকে -অভিধান ,ব্যাকরণ, বর্ণপরিচয় সংকলন-প্রণয়নের সময় থেকে। সংস্কৃতের শাসন মেনে তখন অনেক শব্দের বানান পঠিত হলো-প্রয়োজনের যেমন ,অপ্রয়োজনেও। কিন্তু তাতেও বানানের,বিশেষ করে, অসংস্কৃত শব্দের বানানের নিয়ম একরকম হলো না। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানত অসংস্কৃত শব্দের, সামান্য ক্ষেত্রে সংস্কৃত শব্দেরও, বানানের নিয়ম তৈরি করলেন। এর সঙ্গে আবার কিছু ভেদ হলো বিশ্বভারতী প্রবর্তিত বানানে। তাই আমরা দোটনায় পড়ে গেলাম : বাঙালী লিখব না বাঙালি? বাংলা বানানের নিয়ম বইতে মাহবুবুল হক বাংলা বানানের নিয়মগুলো তুলে ধরেছেন। তিনি গভীর পরিশ্রম করে বহু দৃষ্টান্ত উপস্থিত করেছেন। বিকল্প নিয়মগুলো আমরা সচারাচর ভুল করি; তার শুদ্ধরূপ নির্দেশ করেছেন । বিকল্প নিয়মগুলো তিনি উল্লেখ করেছেন: তবে সহজ ও সুষম মানানের ওপরেই সংগতভাবে জোর দিয়েছেন। প্রয়োগজনিত ভুলেরও তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন তিনি। যাঁরা বাংলা বানান ঠিকমতো লিখতে চান,এ বই তাদের খুব উপকারে আসবে। এমন একটি সময়োচিত গ্রন্থ উপহার দেওয়ার জন্যে আমি মাহবুবুল হককে অভিনন্দন জানাই। আশা করি, এ বই সকলকে শুদ্ধ বানান লিখতে সাহয্য করবে। -আনিসুজ্জামান বাংলা বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
গবেষক ড. মাহবুবুল হক অধ্যাপনার পাশাপাশি প্রবন্ধ রচনা, ফোকলোর চর্চা, গবেষণা, অনুবাদ, সম্পাদনা ও পাঠ্য বই রচনা করে দেশে-বিদেশে পরিচিতি লাভ করেছেন। এর মধ্যে তাঁর চল্লিশটিরও বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ, ভারত ও পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে। ভারতের কলকাতা, যাদবপুর, বিশ্বভারতী, কল্যাণী, পাতিয়ালা, গৌড়বঙ্গ ও আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, ত্রিপুরায়, কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে ও বাংলা আকাদেমিতে ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস ও ফোকলোর বিষয়ে সম্মেলন ও সেমিনারে অংশ নিয়ে গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন তিনি। ২০০৭-এ দিল্লিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সার্ক ফোকলোর উৎসবে তিনি যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধি হয়ে। মাহবুবুল হকের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : বাংলা বানানের নিয়ম, রবীন্দ্র সাহিত্য রবীন্দ্র ভাবনা, নজরুল তারিখ অভিধান, ইতিহাস ও সাহিত্য, লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি, বাংলার লোকসাহিত্য : সমাজ ও সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা : কয়েকটি প্রসঙ্গ, রবীন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ. বাংলা সাহিত্যের দিক-বিদিক, প্রবন্ধ সংগ্রহ ইত্যাদি। এছাড়াও তিনি বহু পাঠ্যবই ও শিশুতোষ গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। লেখালেখি ও গবেষণার জন্য মাহবুবুল হক লাভ করেছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। সেগুলির মধ্যে রয়েছে : ফিলিপস পুরস্কার, মধুসূদন পদক, নজরুল সম্মাননা, মুক্তিযুদ্ধ পদক, চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কার, রশীদ আল ফারুকী সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি।