সাতান্ন বৎসর বয়সে জলধর বন্দ্যোপাধ্যায় নামক সেই অতি সাধারণ, বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকটি দুটি পুত্র, একটি পুত্রবধূ, স্ত্রী, বিবাহিতা, কন্যা রেখে মারা গেলেন। জলধর ব্যানার্জি সেই জাতের লোক, ‘বেঁচে ছিলাম’ এ-কথাটা ঘোষণা করার জন্য মরা ছাড়া যাদের আর কোনো পথই খোলা নেই। রোগা, বেঁটে, একটু কুঁজো, হাতের শিরাগুলি পাকানো, ভুরুর মাঝখানে তিন চারটি ঘন-পাতলা রেখা—জলধর ব্যানার্জির এই দেহটা একটা আশ্চর্য ভঙ্গিতে তক্তপোশের ওপর পড়েছিল— সেই তক্তপোশটা—যার কাঠের দৃঢ়তা ও অমরতা নিয়ে জলধরবাবু সারাজীবন বাণী প্রচার করেছেন। সেই অমর, একটুও না-নড়া, পাথরের মত ভারী, একজন রোগাপ্যাটকা লোকের পক্ষে বিশাল তক্তপোশটার ওপর জলধরবাবুর শরীরটা অদ্ভুত মহিমা নিয়ে পড়েছিল, যেন, বিনাযুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী দিতে অস্বীকৃত দুর্যোধন কুরুক্ষেত্রের মাটির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করছেন। বাইরে বাঁশ ফাঁড়ার আওয়াজ উঠছে। পাড়ার ছেলেছোকরারা নীরবে, প্রায় নিঃশব্দে ব্যবস্থাদি করছে। বাঁশ ফেঁড়ে নারকেল দড়ি দিয়ে বেঁধে-বেঁধে জলধর বাবুকে শ্মশানে নিয়ে যাবার খাট তৈরি হচ্ছে। সেই বিশাল পালঙ্ক থেকে জলধরবাবুর শরীরটাকে নিয়ে যাওয়া হবে ঐ দেড়হাত চওড়া বাঁশের খাটে। জলধরবাবুর দেহটাকে ঘিরে বসে তাঁর স্ত্রী, আর পাড়া-প্রতিবেশিনীরা। পুত্রবধূ বাইরে, জলভরা চোখে যে যা বলছে করে দিচ্ছে! দুই ছেলে একেবারে বাইরের মাঠে দাঁড়িয়ে। মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে, তার করা হয়েছে। জলধরবাবুর আত্মীয়স্বজনরা কেউ খাটের পাশে, কেউ বাইরে। জলধরবাবুর অফিসের সহকর্মীরা এসেছেন। তাঁদের মধ্যে জলধরবাবুর চেয়ে বয়স্ক একজন বাইরের বারান্দায় চেয়ারে হাসপাতালের মেটার্নিটি ওয়ার্ডের বারান্দায় নতুন স্বামী, হবুবাবার মত মুখ করে বসে আছেন। সমবেত জনমণ্ডলীকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এক, যারা কাজে ব্যস্ত। দুই, যারা এসে একবারমাত্র জলধরবাবুর মরা শরীরটা দেখে, তাঁর কথা আলোচনা করছিল। তিন, যারা একবারে চুপ—জলধরবাবুকে ধরাধরি করে যখন বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই বিশাল তক্তপোশটা থেকে ঝাঁপিয়ে মেঝেতে পড়ে কান্না শুরু করবে এই অপেক্ষায়। গত পঁচিশ বছর ধরে জলধরবাবু যে এক ও অকৃত্রিম চেহারায় সকলের কাছে প্রত্যহ আবির্ভূত হয়ে নিজের অস্তিত্বটাকে মুছে এনেছিলেন ঠিক সেই চেহারায় তক্তপোশটার ওপর শায়িত দেহটা সবাইকে চমকে দিয়ে জানাল, অ্যাঁ, এ লোকটা বেঁচে ছিল এবং মরে গেল। জলধরবাবু সপ্তাহে একদিন দাড়ি কামাতেন। সেই দিনটি আসবার আর-দুদিন বাকি ছিল। একটুখানি চোপসানো মুখভর্তি একরাশ শাদা দাড়ি সেই হিশেবটা ধরিয়ে দিতেই জলধরবাবুর দাড়িকাটার কথা ও দৃশ্য সবার মনে ও চোখে ভেসে উঠল।
দেবেশ রায় (জন্ম ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৬) একজন বাঙালি ভারতীয় সাহিত্যিক। জন্ম অধুনা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পাবনা জেলার বাগমারা গ্রামে। ১৯৭৯ সাল থেকে তিনি এক দশক পরিচয় পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস যযাতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল: মানুষ খুন করে কেন (১৯৭৬), মফস্বলী বৃত্তান্ত (১৯৮০), সময় অসময়ের বৃত্তান্ত (১৯৯৩), তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত (১৯৮৮), লগন গান্ধার (১৯৯৫) ইত্যাদি। তিস্তা পাড়ের বৃত্তান্ত উপন্যাসটির জন্য তিনি ১৯৯০ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন।