আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতাগুলোর একটি হলো এর কোনো কমন গ্রাউন্ড নেই। প্রতিটি সমাজের সমাজবিজ্ঞান ভিন্ন এটি একটা বাস্তবতা। কিন্তু মানুষ হিসেবে ও মানুষের তৈরি সমাজ হিসেবে সকল ক্ষেত্রে একটি কমন গ্রাউন্ড থাকা প্রয়োজন। পশ্চিমা সমাজবিজ্ঞান এটিকে অস্বীকার করে এবং এ চিন্তার ফলেই পরবর্তীতে জাতীয়তাবাদ, আঞ্চলিকতাবাদের ন্যায় সংকীর্ণ চিন্তার উত্থান ঘটে। ইবনে খালদুন তাঁর ইলমুল উমরানের আলোচনা তুলে ধরার সময় সকল অঞ্চল ও স্থানভেদে ভিন্নতার প্রয়োজনীয়তাকে গ্রহণ করেই সামগ্রিকভাবে মানবসমাজে কার্যকরী কিছু অভিন্ন ও মৌলিক মূলনীতি তুলে ধরেছেন। সময় ও স্থানভেদে এগুলো সর্বদাই অপরিবর্তনীয়। এ মূলনীতিই হলো আসাবিয়্যাত। পশ্চিমা তত্ত্ব অনুযায়ী, আঞ্চলিকতা ও পরিবেশের ভিন্নতাকে উৎরে কারো পক্ষে ঐক্য ও সংহতির অভিন্ন প্লাটফর্ম তৈরি করা সম্ভব নয়। ইবনে খালদুনের মতে, নবুওয়ত ও একজন পয়গাম্বরের পক্ষে এমন একটি অভিন্ন ক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব এবং একজন পয়গাম্বরের আদর্শকে অনুসরণ করে একটি ঐক্যবোধ তৈরি করা একান্ত বাস্তব। আমরা যারা বিভিন্ন একাডেমিয়া, প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়ি, তারা কি আদৌ নিজেদের সমাজবিজ্ঞান পড়ি? নাকি বহির্গত কিছু তত্ত্বের চর্বিতচর্বণ করে যাই আজীবন! আধুনিক সমাজবিজ্ঞানে আমরা ম্যাক্স ওয়েবার, অগাস্ট কোঁত, দুরখেইম, মার্সেল মস, মার্ক্স, দ্যু বয়েস, গুস্তাভ লে বনকে পড়ি। অথচ এদের অধিকাংশই হলেন জার্মান, ফরাসি, ব্রিটিশ। এরা বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় ইসলামী সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বাংলা অঞ্চলে কতটুকু প্রাসঙ্গিক? কতটুকু সাযুজ্যপূর্ণ? এ পার্থক্যকে না বুঝার কারণেই আমরা আজীবন জার্মান সোসিওলজি, ফ্রেঞ্চ সোসিওলজি পড়ে যাই এবং বাংলাদেশে সে থিওরীর আলোকেই চিন্তা করি। অথচ এ তত্ত্বগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক, ভূতাত্ত্বিক ও দেশীয় বাস্তবতায় কোনো প্রাসঙ্গিকতা বহন করে না! একে না বুঝার কারণেই বাংলাদেশের বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত আন্দোলনকে (যেমন, তিতুমীরের সংগ্রাম, ফরায়েজী আন্দোলন) মার্ক্সীয় তত্ত্বের ছাঁচে ফেলে কম্যুনিস্টরা শ্রেণি সংগ্রাম হিসেবে ব্যাখ্যা করতে চান, বিভিন্ন সংগ্রামী অবস্থানের মাঝে ফরাসি বিপ্লবের ছায়া খুঁজে পান। এটি মূলত নিজস্ব মাটি ও ভূখ-কে ধারণ না করে আজীবন বহির্দেশীয় চিন্তাগত আধিপত্যের শিকার হওয়ার ফল! ‘নিজেদের উৎসসমূহের আলোকে নিজেদের ভিত্তি ও অবস্থান তৈরি’ মিহওয়ার এর বর্ষপূর্তি সংখ্যায় এটিই আমাদের স্লোগান। এছাড়াও বর্ষপূর্তি এ সংখ্যার বিশেষ প্রবন্ধে থাকছে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ড. সাঈদ রামাদানের লেখা। ‘আখলাক ও নন্দনতত্ত্ব’ বিভাগে অনূদিত হয়েছে মুসলিম উম্মাহর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও উসূলবিদ আলেম প্রফেসর ড. মেহমেদ গরমেজের গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ “রহমানী আখলাক”। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভাগে অনূদিত হয়েছে মালেশিয়ার ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম আব্দুল হাদী আওয়াং এর বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে এক ঐতিহাসিক বক্তব্য। অর্থনীতি নিয়ে লিখেছেন তরুণ চিন্তক সায়েম মুহাইমিন এবং রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন শ্রদ্ধেয় নাজমুল রেজা। কৃষি নিয়ে লিখেছেন শ্রদ্ধেয় আশিকুর রহমান সৈকত। এছাড়া সিনেমা পর্যালোচনা করেছেন রিয়াজ আহমেদ। বই পর্যালোচনায় আলোচিত হয়েছে ইমাম আবু হানিফার চিন্তা ও দর্শনের উপর উপমহাদেশের মহান আলেম আল্লামা শিবলী নোমানীর পর্যালোচনামূলক গ্রন্থ “সীরাতে নোমান”। ব্যক্তিত্বে থাকছে বাংলাদেশের স্বনামধন্য ইকবাল গবেষক ড. আব্দুল ওয়াহিদের লেখনীতে মুসলিম উম্মাহর মহান আলেম, চিন্তক, দার্শনিক আল্লামা ইকবালের জীবন ও চিন্তার বিশ্লেষণী আলোচনা। বরাবরের ন্যায় এবারও সময়ের সেরা চিন্তাবিদগণের লেখনী ও তরুণ চিন্তকদের লেখনীর মেলবন্ধনের মাধ্যমে ইতিহাস ও নতুনত্বের ছোঁয়ায় উপস্থাপিত হবে ‘জ্ঞানের পুনর্জাগরণ ও নবধারার কাগজ’ মিহওয়ার এর চতুর্থ সংখ্যা।
হাসান আল ফিরদাউস জন্ম : বাংলাদেশের টাংগাইল জেলায়। তিনি সমাজবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি 'ইসলামী চিন্তা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের' ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন এবং ত্রৈমাসিক মিহওয়ারের সম্পাদক।