ভূমিকা আমেরিকায় সাইকেল চালানোর তাগিদটা পুরনোই। স্বপ্নের দেশ' আমেরিকায় মানুষ গেলে আর ফিরে কেন আসতে চায় না, সেটা চেখে দেখার লালসা বহু দিনের। দুনিয়ায় আরো কত কত দেশ, ছোট দেশ, বড় দেশ, পাহাড়ের দেশ, সাগরের দেশ, মেঘের দেশ, বালির দেশ আবার অনেকের কাছে না-ফেরার দেশ। কিন্তু আমেরিকা, আমেরিকাই। কেন, তার উত্তর জটিলই। আটলান্টিকের ওপারের দেশে শতক ধরে মানুষ জীবিকার জন্য হোক আর ভাগ্যের অন্বেষণেই হোক, গিয়েছেন, থিতু হয়েছেন। গড়েছেন একদম আলাদা এক রাষ্ট্র। যে-রাষ্ট্রে অধিবাসী হয়েছেন অভিবাসী হয়ে। আমেরিকা তাই সারা পৃথিবীর সবচেয়ে পরিচিত দেশ। আমার উচাটন মনও অবচেতনে আটকে যায় এর রূপকথায়। রাস্তা কিছুটা সহজ ছিল যদি আমি প্রচলিত পথে এগিয়ে যেতাম। কিন্তু “দেখতে চাই ধরণি' মার্কা রোমান্টিসিজমে বেঁকে বসে জীবন। তাই চাকরি ছাড়তে হয় দুনিয়া দেখার লোভে। সামনে কী হবে, কী আছে, কী থাকবে- সে-হিসাব মেলানোর ক্যালকুলাসে একদমই কাঁচা আমি বরাবর। তাই প্রকৌশলী হয়ে আমেরিকা যাওয়ার চেয়ে সাইকেলে আমেরিকা যাওয়ার পথ মাড়াতেই মন সায় দিলো বেশি। চুলোয় গেল ১৬ বছরের তাবড় তাবড় বইপত্রের বিদ্যা। জমানো টাকা আর বন্ধুবান্ধবের ধারের বোঝা কাঁধে নিয়ে সাইকেলের শুরু – দেশ, মহাদেশ, যতটুকু টাকায় কুলিয়েছে, চেষ্টা করে গেছি দুচাকায় দুনিয়া দেখতে। আর তারও সাত বছর পর আমেরিকার পশ্চিম থেকে পূর্ব উপকূল পর্যন্ত সাইকেল যাত্রা। ভিসা পাওয়ার গল্পটা অনেক বড়। সে গল্প আমাদের অনেকের মতোই। তাই আর শুরু না করাই ভালো। শেষমেশ ২০১১-তে এক কনফারেন্সে পোস্টার প্রেজেন্টেশনের আমন্ত্রণে ভিসা মিলেছিল। আর সেটাই সুযোগ হয়ে এসেছিল। কিন্তু আমেরিকা আসার পর, যাদের সহযোগিতা ছাড়া এই যাত্রা ভীষণ কঠিন হয়ে যেত, তাদের কথা না বললেই নয়। এই ধরনের দীর্ঘ কোনো অভিযানে সবকিছু বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই যাত্রা শুরুর আগে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, রসদ জোগাড় করাও একটা বড় কাজ হয়ে যায়। সাইকেল মেরামতের জন্য মেকানিকের কাছে যাওয়া, ক্যাম্পিংয়ের জন্য তাঁবু, রান্না করার স্টোভ থেকে শুরু করে অনেক কিছু। সকাল-বিকেল-রাত একাকার করে সহযোগিতা করেছেন সনি কামালভাই। নিউইয়র্কে তাঁর সাহায্য ভোলার নয়। আমার বন্ধু সুমু আর কবিরভাই, যাদের বাড়িতে সময়ে অসময়ে হানা দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালে প্রথম আমেরিকা ভ্রমণের সময় এই নিউইয়র্কেই গাড়ির জানালা ভেঙে আমার ক্যামেরাসমেত টাকা-পয়সা যা কিছু ছিল, সব চুরি হয়ে গিয়েছিল। সেই স্মৃতির ভয়াবহতা আজও আমাকে হানা দেয়। চোখের পলকে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়া যে কত সহজ তা বলে বোঝানো কঠিন। সেই ভয়াবহ স্মৃতিকে মুছে দেওয়ার জন্য আমার চার বন্ধু প্রিতম, বাপ্পি, আফজাল ও আরমানের অভিলাষ না বললেই নয়। চুরি হয়ে যাওয়া ক্যামেরার চেয়ে আরো ভালো ক্যামেরা কিনে দিয়েছিল এ-চারজন। এই গল্পের দৈর্ঘ্য অনেক। শুধু আভাস দেওয়া গেল। এই বইয়ের সব ছবি তোদের জন্য। আমার সহপাঠী ওয়াহিদ, জয়দীপ; অনুজপ্রতিম হাসান তারেক; ওয়াশিংটন ডিসিতে পাপ্পুর (ইশতিয়াক) আতিথেয়তা না পেলে শেষটা কষ্টের হতো। দোলনভাই, মাসুদভাই, শামিমভাইয়ের কথা চলে এসেছে নানাভাবে। ঠিক সেভাবে রাগিব হাসানভাইয়ের সহযোগিতাও কাজে লেগেছিল বেশ। আমি বুয়েটের না হয়েও বুয়েটিয়ানদের যে-সহযোগিতা পেয়েছিলাম, তা ভোলার নয়। আমরা বোন মাফরুহা ও তার পরিবার, আমার ভাই এনায়েত - অস্ফুটে সলজ্জ বলার চেষ্টা করছি, নীরবে তোমাদের রেখে গেলাম। ২০১২ সালের ঘটে যাওয়া ঘটনাকে লিখে ফেলতে যার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি ছিল, তিনি আমার বন্ধুপ্রতিম রাফিক হারিরিভাই। তিনি এতবার লিখতে বলেছেন যে, শেষমেশ বইটা লিখে ফেলা গেছে। ১০ বছর বেশ লম্বা সময়। তাই সে-সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে যথাসম্ভব সুচারুভাবে তুলে ধরার জন্য যারা সাহায্য করেছিলেন, তাদের প্রায় সবার সঙ্গেই একাধিকবার কথা বলা হয়েছে । তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ । সময়-অসময়ে বিরক্ত করার জন্য । প্রখ্যাত লেখক, ইলাস্ট্রেটর সুজি বেকার ও National Oceanic and Atmospheric Administration-এর সারাহ মরিসন এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের লুভা নাহিদ চৌধুরী আপাকে বিশেষ ধন্যবাদ। এই বই আপনাদের কাছে কণী। মুনতাসির মামুন
মুনতাসির মামুন জন্ম বগুড়ায় ১০ নভেম্বর ১৯৮২ সালে। পড়াশুনা করেছেন ঢাকার ধানমণ্ডি গভঃ বয়েজ হাই স্কুল, নটরডেম কলেজ এবং গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভাসিটি অব টেকনোলজিতে ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রিনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং এ। ওশান কনজারভেন্সি এবং ব্যান্ফ মাউন্টেন ফিল্ম ফ্যাস্টিভাল ওয়ার্ড ট্যুর-এর বাংলাদেশ সমন্বয়ক। ভ্রমণ, অভিযান এবং পরিবেশ নিয়ে লেখালেখি দুই দশকের বেশি সময় ধরে। পরিবেশ নিয়ে গবেষণা এবং গণসচেতনতার জন্য ওয়ার্ল্ড ব্যাংক-এর ‘‘কানেক্ট ফর ক্লাইমেট” পুরস্কার, বৃটিশ কাউন্সিলের ‘‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইমেট চ্যাম্পিয়ন” পুরস্কার, আলোকচিত্রী হিসেবে আইইউসিএন-এর ‘‘বায়োডাইভারসিটি ইন ফোকাস”, ‘ইন্টারন্যাশনাল এইডস সোসাইটি’ পুরস্কার লাভ করেছেন। আজীবন স্কাউট এবং বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটারস অ্যাসোসিয়েশনের সভ্য। দেশে এবং বিদেশে তাঁর আলোকচিত্র প্রর্দশনীর সংখ্যা ছয়টি। পর্বতারোহণ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বই দুটি। এভারেস্ট (২০০৫), দ্য টার্টেল নেক (২০০৮)।