মুখবন্ধ ১. কেন জানতে হবে বাংলা বানান? উল্টো দিক থেকেও এই প্রশ্ন করা যায়, কেন জানতে হবে না বাংলা বানান? বাংলা আমার মাতৃভাষা, আমার পূর্বপুরুষেরা এই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে বাংলা ভাষার প্রয়োজন হচ্ছে- সেই ভাষা লেখার এবং বলার নিয়ম আমাকে কেন জানতে হবে না? দেখা যায়, ইংরেজি ভাষায় আমি যদি কথা বলতে যাই তাহলে একটি শব্দ এদিক-ওদিক হলে অনেকেই ভুল ধরছে, হাসাহাসিও করছে। আমিও সেই ভয়ে ইংরেজি বলতে চাইছি না। অথচ সেটা একটা বিদেশি ভাষা, ভুল হতেই পারে। সেই বিদেশি ভাষা নিয়ে আমাদের হীনম্মন্যতার শেষ নেই, কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে? বাংলায় কথা বলার সময়ে বা লেখার সময়ে কিন্তু আমাদের এমন চিন্তা হয় না, তেমন কেউ ভুলও ধরে না। অথচ অধিকাংশ সময়েই আমরা ভুল লিখছি, বানানের ভুলটাই সবচেয়ে বেশি। মূল কথা হলো, আমাদের সচেতন হতে হবে। নিজেকেই চাইতে হবে যে, আমি বানানটা শিখতে চাই, চর্চা করতে চাই, ভুল বাংলা বললে বা লিখলে যেন আমি লজ্জা পাই। এছাড়া অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রেও দেখা যায় শিক্ষার্থীরা বাংলা বিষয়টিকে বেশি ভয় পায়। কেন ভয় পায়? কারণ প্রথমে এটাকে তারা সহজ বিষয় ভেবে ফেলে রাখে, তারপর পড়া জমে জমে কঠিন হয়ে ওঠে। এই অবস্থা থেকেও পরিত্রাণের উপায় হলো শিক্ষার্থীদের ইচ্ছাশক্তিকে জাগিয়ে তোলা। ২. বাংলা একাডেমি বানানরীতি প্রসঙ্গ আমাদের অনেকের কাছে একটি প্রিয় প্রসঙ্গ হলো বাংলা বানানের কথা এলে প্রথমেই বাংলা একাডেমিকে তুলোধুনো করা। তারাই নাকি বাংলা বানানের বারোটা বাজিয়েছে, বারবার নিয়ম তৈরি করে ঝামেলা পাকাচ্ছে-ইত্যাদি। আসলে যদি আমরা ঠিক তথ্যটি জানতাম তাহলে বুঝতাম যে বাংলা একাডেমিই বরং বাংলা বানানের নিয়মকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করছে। আমরা অনেকেই জানি, মূলত উনিশ শতকের আগে পর্যন্ত বাংলা বানানের নিয়ম বলতেই তেমন কিছু ছিল না। উনিশ শতকের শুরুর দিকে যখন সাহিত্যিক বাংলা গদ্যের উন্মেষ হতে শুরু করল তখন ধীরে ধীরে কিছু নিয়ম-কানুন তৈরি হতে শুরু করে। প্রথমত বাংলা বানানের নিয়ম সফল ও গ্রহণযোগ্যভাবে প্রবর্তন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। অনেকদিন পর্যন্ত সেই নিয়মই অনুসরণ করা হচ্ছিল বাংলা বানানের ক্ষেত্রে। তবে সেই নিয়মে বিকল্প ছিল বেশি। ফলে সময়ের প্রয়োজনেই, বিশেষত অতৎসম শব্দের বানানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এই নিয়মগুলোর আরও সমতা বিধান করার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ কারণেই ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবার ‘বাংলা একাডেমী প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ নামক পুস্তিকার মাধ্যমে বানানরীতি প্রবর্তন করে বাংলা একাডেমি। এরপর বিভিন্ন সময়ে একাডেমির পক্ষ থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রণীত বাংলা বানানের নিয়মাবলি পর্যালোচনা করে সর্বাধিক সমতাবিধান করা সম্ভব- পরিমার্জিত আকারে এমন একটি বানানরীতি প্রকাশ করে আসছে। আমরা অনেক ক্ষেত্রেই এসব বিধি-বিধান পড়ি না, মনে রাখি না-এই কারণে দোষ পড়ে বাংলা একাডেমির ওপরে! যেন নিয়ম তৈরি করতে গিয়ে তারাই অনিয়ম করে ফেলেছে। কিছু ক্ষেত্রে যদিও বাংলা একাডেমি আপস করে ফেলার কারণে বানান-সমতা কিছুটা দূরবর্তী-এই আশঙ্কাও ঝেড়ে ফেলা যায় না। যেমন: বিদেশি শব্দে ‘জ’ লিখতে হবে আবার এরপরেই বলা হয়েছে ইসলাম ধর্ম-সংক্রান্ত কয়েকটি শব্দে বিকল্পে ‘য’ লেখা যেতে পারে। তা সত্ত্বেও আমরা মনে করি, বাংলা একাডেমি বানানরীতি সর্বস্তরে অনুসরণ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। যদি বানানের ঝামেলা এড়াতে চাই তাহলে এই ঝামেলার মুখোমুখি হয়েই সেটা করতে হবে বইকি!