"ঢাকার রাজপথের ইতিহাস" বইটির 'আমার কথা' অংশ থেকে নেয়াঃ ঢাকা বাংলা আর বাঙালির বহু গৌরবময় ঐতিহ্যের সাক্ষী এক প্রাচীনতম নগরী। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা এই নগরী শত শত বছরের সাধনায় তিল তিল করে গড়ে উঠতে উঠতে আজ তিলােত্তমা নগরী। এই তিলােত্তমা নগরীর রাজপথের ইতিহাসের নেপথ্যে আছে বহু বর্ণিল ঘটনারাশি আর আছে বহু সম্রাট ও রাষ্ট্রনায়কদের শাসনামলের ঘটনাপ্রবাহ। বায়ান্ন গলি তিপ্পান্ন বাজারে’র নগরী বলা হতাে যে ঢাকাকে, সেই ঢাকা তাে আজ আর বায়ান্ন গলি কিংবা তিপ্পান্ন বাজারের সীমানায় সীমিত নেই। আজ আধুনিক কসমােপলিটান ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী হিসেবে এতটাই বিস্তৃত যে, কত শত বাজার আর কত হাজার হাজার গলির শহরে রূপান্তরিত হয়েছে তা সত্যি সত্যি গবেষণার বিষয়। একদার বুড়িগঙ্গার তীর থেকে ইসলামপুর, লালবাগ, নবাবপুর, গুলিস্তান, রমনা আর পল্টনের সীমানায় সীমিত এক চিলতে শহর ঢাকা, আজ কত ব্যাপক বিস্তৃত সে আলােচনারও অবকাশ নেই সীমিত পরিসরে। ঢাকার রাজপথের সেই সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরতে গেলে ঢাকার ইতিহাসও অনিবার্যভাবেই এসে যায়। এসে যায় ঢাকা নগরী পত্তনের নেপথ্যে যে সব সম্রাট অবদান রেখেছেন তাঁদের কথা, এসে যায় ঢাকা কেমন করে তার ‘ঢাকা’ নাম পেলাে, কখন জাহাঙ্গীরনগরে রূপান্তরিত হলাে এমনি অনেক প্রসঙ্গ। ঐতিহাসিকগণ ঢাকার নামকরণ প্রসঙ্গে নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তবে সর্বাধিক গ্রহণযােগ্য যে অভিমত, তা হলাে বাংলার সুবাদার শেখ আলাউদ্দিন ইসলাম খান ১৬০৮ সালে ঢাকায় আগমন করেন। নতুন রাজধানীর স্থান নির্ণয়ের জন্য তাঁর সঙ্গে বহু নৌকারােহী মাঝিমাল্লাও ছিল। তাঁরা নৌকায় বর্তমান ঢাকার অপর পাড়ে যখন এসে ভিড়লেন, তখন ইসলাম খানের মনে হলাে এই স্থানই সব থেকেই দিক রাজধানীর উপযােগী। তিনি যে স্থানে এসে নামলেন, তা আজো ঢাকার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ইসলামপুর নামে প্রসিদ্ধ। কিছুকাল পর ইসলাম খান নদীর তীরে গিয়ে দেখেন যে, একদল হিন্দু ঢাক-ঢােল বাজিয়ে পূজা করছে। এ দৃশ্য দেখে সুবাদার ইসলাম খানের মনে এক নতুন কল্পনা জাগলাে, তিনি সব ঢাক বাদককে এক স্থানে দাঁড় করিয়ে জোরে জোরে ঢাক বাজাতে বললেন। অপরপক্ষে, তিনি তার তিনজন সাথীকে নিশান নিয়ে পূর্ব উত্তর পশ্চিম দিকে পাঠিয়ে দিলেন। তাদের প্রত্যেককে আদেশ দিলেন— শেষ যে স্থানে গিয়ে তারা ঢাকের আওয়াজ শুনতে পাবেন, সেখানেই যেন একটি নিশান গেড়ে আসেন। এইভাবে সুবাদারের আদেশ পালিত হওয়ার পর তিনি ঢাকের শব্দানুযায়ী এই শহরের নাম রাখলেন ‘ঢাকা’। আর সেই সাথে সাথে পূর্ব, উত্তর এবং পশ্চিম দিকে ঢাকা শহরের সীমারেখাও টানা হলাে। দক্ষিণ সীমানা রইল বুড়িগঙ্গা নদী। এরপর সুবাদার ইসলাম খান ১৬১২ সালে আপন কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্রাটের নামানুসারে ঢাকার নাম রাখলেন ‘জাহাঙ্গীরনগর'। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সেই ঢাকা। সেই অতীত ঢাকার উত্থান-পতন ও গৌরব কাহিনী কালের স্রোতে হারিয়ে গিয়েছে। আর কিছু বেঁচে আছে, অতীত ইতিহাসের দীর্ঘশ্বাসে। ঢাকা নগরীর দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালােচনার অবকাশ নেই এখানে। ঢাকার রাজপথের ইতিহাস লিখতে গেলে চেতনায় অবশ্যই জেগে উঠবে বাঙালীর স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সংগ্রামে বিজয়ী হওয়া পর্যন্ত বহু সংগ্রামী ঘটনা। এই রাজপথ বার বার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। এখানে এই কঠিন কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে আছে বহু রক্ত, অশ্রু আর গৌরবময় সংগ্রামের ইতিহাস। কালের সাক্ষী হয়ে আছে এই রাজপথ। এখানে বৃটিশ-বিরােধী আন্দোলনে মুখর বাঙালির বিক্ষুব্ধ স্লোগান যেন ঘুমিয়ে আছে পাথর কংক্রিটের নিচে। এখানে যেন নিঃশব্দে ঘুমিয়ে আছে বায়ান্নর ভাষা শহীদদের অমর আত্মা। আইয়ুবী স্বৈরশাষণ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম-উত্তর কাল পর্যন্ত বহু সংগ্রামী ঘটনায় মুখর হয়ে আছে ইতিহাস। সে ইতিহাস মহানগরী ঢাকার রাজপথেরই ইতিহাস। এখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কত রক্ত ঝরেছে। শহীদ মতিউর, আসাদ কিংবা নূর হােসেনের মতাে শহীদের লােহিত গন্ধ এখনও জেগে আছে এই রাজপথে। ঢাকার রাজপথের সেই গৌরবময় অতীত-গাঁথা নিয়ে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস যদি কাউকে ঢাকার রাজপথ সম্পর্কে সামান্য কৌতূহলীও করে, তা হলেই শ্রম সার্থক হয়েছে বলে ভাববাে।