বাংলা ভাষায় আরবি ও ফারসির সংখ্যা কত? -এমন প্রশ্নের নিখুঁত কোনো জবাব নেই। আরবি ও ফারসি শব্দমালা বলতে বাংলা ভাষায় মুসলমানদের মাধ্যমে আগত আরবি, ফারসি, তুর্কি, উর্দু ও হিন্দি শব্দমালা মুসলমানদের মাধ্যমে আগমন ঘটেনি। সুতরাং শব্দটি নথিভুক্ত করা বাঞ্ছনীয় শব্দমালাকে বুঝায়। বলা হয়ে থাকে বাংলা ভাষায় এ ধরনের শব্দ-সংখ্যা আট হাজারেরও অধিক। বাংলা পিডিয়ার প্রধান সম্পাদক ড. সিরাজুল ইসলাম পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধে বলেছেন যে, এ সংখ্যা ১০ হাজারের মতো। এই সংখ্যা আট হাজারই হোক বা ১০ হাজারই হোক— মুসলমানদের মাধ্যমে আগত একটি বিশাল সংখ্যার শব্দসম্ভার বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশে গিয়ে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। এ শব্দগুলো বাংলা ভাষার স্থায়ী সম্পদে পরিণত হয়ে গেছে। আর এ শব্দগুলো বাংলাভাষী হিন্দু ও মুসলমান সবাই তাদের লেখায় প্রায় সমানভাবেই ব্যবহার করে থাকে। বাংলা ভাষার সাধারণ অভিধানগুলোয় আরবি- ফারসি শব্দমালার অন্তর্ভুক্তি মোট আরবি-ফারসি শব্দের এক-চতুর্থাংশের মতো হয়ে থাকে। এদেশ প্রায় নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশ। কাজেই বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দমালার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টিতে বর্তমান বইটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে। কথা বলায় বা লেখায় শব্দচয়ন সব সময়ই শ্রোতা বা পাঠকের প্রতি শ্রদ্ধা বা দরদবোধ রেখেই করতে হয়। একজন মুসলমানের নামের আগে ‘জনাব’-এর বদলে 'শ্রী' লিখলে সেই ব্যক্তি খুশি হবেন না। যদিও অর্থের দিক থেকে ‘শ্রী’ কোনো খারাপ শব্দ নয়। কিন্তু প্রচলিত রেওয়াজকে শ্রদ্ধা করতে হয়। তেমনি কোনো মুসলমানের ‘লাশ’-কে ‘মরদেহ' বলা অনুচিত। কোনো মুসলমান মারা গেলে তাঁর লাশকে গোসল করিয়ে, কাফন পরিয়ে; আতর-খুশবু মাখিয়ে, জানাজার নামাজ আদায় করে অনেক তাজিমের সঙ্গে কবরে শুইয়ে দেওয়া হয়। এখানে ‘মরদেহের সৎকার করা হয়েছে' বলা অশোভন। মৃত মুসলমানের বেলায় তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করা হয়। কিন্তু তাঁর বিদেহী আত্মার সদগতি কামনা শোভন নয়। একজন মুসলমানের লাশ দাফন-কাফনের পর মিলাদ, কুলখানি, জেয়াফত ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ‘চণ্ডিপাঠ', 'শ্রাদ্ধ', ‘কাঙালভোজ' ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার অশালীনতার পরিচয় বহন করবে। খাসীর গোশত আর পাঁঠার মাংস- এ দুটোর দুরকম আমেজ। মুসলমানদের বাড়িতে ‘খেশ’, ‘মেহমান' আসে, কিন্তু নরেন বাবুর বাড়িতে ‘কুটুম্ব’ আসে। এভাবে বাংলা ভাষায় মুসলমানদের মাধ্যমে আগত শব্দমালার শালীন ব্যবহার ও সচেতনতা সৃষ্টিতে বর্তমান বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যায়। বাংলা ভাষাকে এক সময় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা ইতরজনের ভাষা বলে ঘৃণা করত। সে-সময় বাংলা ভাষার শব্দসম্ভারও খুবই সীমিত ছিল। বিভিন্ন সময়ে নৌপথে ও স্থলপথে এ-দেশে অনেক আরব বণিক ও মুসলমান অলি, দরবেশ তথা ধর্মপ্রচারকের আগমন ঘটে। এসব অলি, দরবেশ ও ধর্মপ্রচারকগণ এ-দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে যেতেন। ফলে তাঁদের ভাষার দৈনন্দিন ব্যবহার্য অনেক শব্দ বাংলা ভাষায় মিশে যায়। এটি ঘটে মুসলমানদের এ-দেশ বিজয়ের অনেক আগেই। তারপর ত্রয়োদশ শতকের শুরুতে বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পর এ-দেশ যখন মুসলমানদের শাসনাধীনে আসে তখন স্বাভাবিক নিয়মে ও প্রয়োজনে অনেক আরবি, ফারসি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষার শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে। পরবর্তী সময়ে মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চার সত্যিকার বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বভাবতই সেই সময়ের রচিত বাংলা সাহিত্যে প্রচুর আরবি, ফারসি, তুর্কি ভাষার শব্দ ব্যবহৃত হয়। মুসলমানদের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় আগত সে-সব শব্দমালা দৈনন্দিন কথা বার্তায় ও সাহিত্যকর্মে ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলা ভাষার নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়ে যায়। এ-দেশের হিন্দু, মুসলমান সকলেই এ-সব শব্দমালা প্রায় সমানভাবেই ব্যবহার করে থাকে । আরবি ও ফারসি-এ দুটো ভাষাই জীবিত ও সমৃদ্ধশালী ভাষা। কোনো জীবিত ভাষা থেকে অন্য কোনো জীবিত ভাষায় শব্দ গ্রহণ করলে গ্রহীতা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়। তাই আরবি ও ফারসি ভাষা থেকে স্বাভাবিক নিয়মে শব্দ প্রবেশ করার ফলে বাংলা ভাষার শব্দসম্ভার সমৃদ্ধ হয়েছে। পণ্ডিতদের মতে আরবি, ফারসি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষা থেকে প্রায় আট হাজার শব্দ বাংলা ভাষায় প্রবেশ করেছিল। এমন বিশাল সংখ্যার শব্দসম্ভারের কিছু কিছু শব্দের ব্যবহার বর্তমানে কমে এলেও এখনও প্রায় ছয় হাজারের অধিক শব্দ বাংলাভাষী মানুষের দৈনন্দিন কথাবার্তায় ও সাহিত্যচর্চায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
Title
আধুনিক বাংলা ভাষায় আরবি ও ফারসি শব্দমালার ব্যবহার
মুহম্মদ আবদুর রসুল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রতনপুর গ্রামে ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামের হাই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করার পর ভাগ্যের অন্বেষণে ঢাকা চলে আসেন। ঢাকার প্রথম জীবন তেমন মসৃণ ছিল না। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কুমিল্লার শ্রীকাইল কলেজ থেকে আইএ এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ সালে গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। তারপর চাকরি সূত্রে রাজশাহী গমন করেন। সেখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে মনোবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। অতঃপর ১৯৭০ সালে ঢাকায় পাবলিক সার্ভিস কর্তৃক মনোনীত হয়ে ১৯৭১ সালে ঢাকায় জাতীয় শিক্ষা ও ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) গ্রন্থাগার বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। চাকরিতে থাকাকালীন ১৯৮০ সালে ভারতের হায়দ্রাবাদের ইনস্টিটিউটে ‘ইনফরমেশন স্টোরেজ অ্যান্ড রিট্রাইভেল সিস্টেমস'-এর উপর একটি স্বল্পমেয়াদি আন্তর্জাতিক ট্রেনিং কোর্স সম্পন্ন করেন। পরের বছর ১৯৮১ সালে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। প্রায় ২৩ বছর সরকারি চাকরি করার পর ‘নায়েম’ থেকে একজন শিক্ষা বিশেষজ্ঞ হিসেবে ১৯৯৪ সালে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি বর্তমানে ঢাকায় অবসর জীবন যাপন করছেন। অবসর জীবনে তিনি ১. বুদ্ধিচর্চা (বুদ্ধি শাণিত করার অনুশীলনী গ্রন্থ), ২. অঙ্কের ম্যাজিক খেলা, ৩. Human Wisdom in a Nutshell, ৪. আধুনিক বাংলা ভাষায় আরবি ও ফারসি শব্দমালার ব্যবহার ইত্যাদি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছেন। প্রথম পাণ্ডুলিপি ‘বুদ্ধিচর্চা” এবং দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি ‘অঙ্কের ম্যাজিক খেলা' হোপ মাল্টিমিডিয়া থেকে প্রকাশিত হয়েছে। জনাব রসুল জ্ঞানের সাহিত্য (নন-ফিকশন) বিষয়ক বইপত্রের একজন নিবেদিত পাঠক। বর্তমানে তিনি শিক্ষা, সমাজ, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে সময় কাটান। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি প্রচারবিমুখ। তিনি ‘প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং'-এ নীতিতে বিশ্বাসী।