মুসলমানরা ঈসায়ি অষ্টম শতকে ইউরোপ পৌঁছে। তারা পশ্চাদপদ ও অসভ্য আন্দালুসকে সভ্যতা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও উন্নতিতে ইউরোপের বাতিঘর হিসেবে গড়ে তোলেন। সেখানে জন্ম নেয় অসংখ্য আলেম, ফকিহ, মুহাদ্দিস, দার্শনিক, কবি-সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও সংগীতজ্ঞ। ঈসায়ি অষ্টম শতক থেকেই আব্বাসি খেলাফতের আমলে পৃথিবীর নানা জ্ঞানভান্ডার নিয়মতান্ত্রিকভাবে আরবিতে অনূদিত হতে থাকে। মুসলমানদের মাধ্যমে প্রাচীন জাতিসমূহের জ্ঞানভান্ডার, বিশেষত ইউনানি জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও কলা ইউরোপে পৌঁছে। ইতিহাস সাক্ষী, ইউরোপের অধিকাংশ ক্লাসিক্যাল সৃষ্টিকর্মের উৎস হলো আরবি সাহিত্য। প্রখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক ও বিজ্ঞানী রজার বেকন ছিলেন আরব শিক্ষকদের ছাত্র। তিনি নিজের ছাত্রদের বলতেন, ‘তোমরা যদি সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে চাও, তাহলে আরবি পড়ো।’ পশ্চিমা লেখকগণ বলে থাকেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস হলো ইউনানি ভান্ডার। কিন্তু তারা একথা বলার সাহস করে না যে, ইউনানি জ্ঞানভান্ডার ছয়শো বছর পর্যন্ত ইস্কান্দারিয়া, এথেন্স ও কুস্তানতিনিয়াতে তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল। সেখান থেকে মুসলমানরাই জ্ঞানগুলো বের করে এনেছে। মুসলমানরা সেগুলোর অনুবাদ করে ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছে; সেখানে থাকা ভুলভ্রান্তি সংশোধন করেছে। মুসলমানদের অনূদিত ও ব্যাখ্যাকৃত ইউনানি গ্রন্থসমূহ তাদের সঙ্গে ইউরোপ পৌঁছে। কিন্তু কী নির্মম পরিহাস, সেই মুসলমানদের সম্পর্কেই বলা হচ্ছে, ‘হাজার বছর পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম শুধু ইউনানি জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনুবাদে সীমাবদ্ধ ছিল। তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে উল্লেখযোগ্য কোনোকিছু বৃদ্ধি করেননি!’ যেহেতু অন্যরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানের কথা বলতে সাহস করে না; গ্যালিলিও, কেপলার, জেরার্ড ও রজার বেকন প্রমুখ মুসলমানদের নকলকারী ছিলেন এ সত্যটি বলবার সাহস করে না; এজন্য ইউরোপে মুসলমানদের এহসান সম্পর্কে আজকের ছাত্র, এমনকি, সভ্যতা, ইতিহাস ও বিজ্ঞানের পাঠকগণ একেবারে অজ্ঞ। আমাদের ছাত্রদের বলা হয়েছে, আমেরিকার আবিষ্কারক হলেন কলম্বাস, আর আফ্রিকা আবিষ্কার করেছেন ডেভিড লিভিংস্টন। কিন্তু তাদেরকে একথা জানানো হয়নি, কলম্বাসের বহু আগেই মুসলমানরা ওই দেশের সন্ধান পেয়েছিল। কলম্বাস তো মুসলিম শিক্ষকদের থেকেই নৌবিদ্যার জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তার নিকট দিকনির্দেশক যে কম্পাস ছিল সেটিও ছিল মুসলমানদের আবিষ্কার! অন্যদিকে আফ্রিকা গমনকারী আরবদের কাছে এমন একটি মানচিত্র ছিল, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা ‘বাহরে রূম’ (ভূমধ্যসাগর), ‘বাহরে কুলযুম’ (লোহিত সাগর), ‘ভারত মহাসাগর’, ‘বাহরে কাহেল’ (প্রশান্ত মহাসাগর) প্রভৃতি সমুদ্রভ্রমণে ব্যবহার করে আসছিলেন। কিন্তু পশ্চিমাদের কথার দ্বারা এমন মনে হয় যে, তারাই যেন মর্ত্য থেকে নিয়ে আকাশপুরির সৃষ্টিকতার্। ভাবখানা এমন যে, কোনো ইউরোপীয় সেদিকে ইশারা না করা পর্যন্ত এসব যেন অস্তিত্বেই আসেনি! যদিও হিমালয় পর্বতশৃঙ্গ কোটি কোটি বছর আগে থেকে গঠন হয়ে আসছে, কিন্তু এর পূর্ণতা পেয়েছে জর্জ এভারেস্টের চোখ যখন সেদিকে পতিত হয়েছে তখন। কী চমৎকার ইতিহাস! আর তাদের দোষ দিয়েই-বা লাভ কী? যে-জাতি নিজেদের ইতিহাস প্রতিপক্ষের মুখে শুনতে পছন্দ করে তারা হয়তো প্রতিপক্ষের বিরোধী অবস্থানে থাকতে পারে, কিন্তু তাদের সামনে যাওয়ার সাহস পায় না। প্রতিপক্ষ সমাজ এমন একটি জাতি, যারা মুসলমানদের অস্তিত্বের স্বীকৃতি পর্যন্ত দিতে নারাজ। মুসলমানরা তাদের থেকে নিজেদের অধিকার কোন পদ্ধতিতে লাভ করতে চায় তা পুর্নবিবেচনা করা উচিত।...
মোমেনশাহী জেলার মুক্তাগাছা থানাধীন গাড়াইকুটি গ্রামটিকে ‘আলেমদের গ্রাম’ বলা চলে। এ গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরেই কেউ-না-কেউ হাফেজ, মাওলানা, কিংবা মুফতি। এরই একটি শিক্ষিত পরিবারের নাম ‘মাস্টার বাড়ি’। জনাব হাসান আলী মাস্টার হাফিজাহুল্লাহ এ বাড়ির কর্তা-পুরুষ। পেশায় তিনি একজন স্কুল শিক্ষক। দীনদার ও মান্যবর ব্যক্তি হিসেবে এলাকায় বেশ নামডাক। তাঁর চার ছেলের প্রত্যেকেই ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। এ পরিবারেই ১৪১৪ হিজরির ১৮ রজব (মোতাবেক ১৯৯৪ ঈসায়ির পহেলা জানুয়ারিতে) মামুনুর রশীদ নদভি জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি শান্ত প্রকৃতির। শিক্ষক পিতার ইচ্ছা ছিল এই ছেলেকে ডাক্তার বানানোর। কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে মাওলানা রেজাউল করীম চাচ্ছিলেন তার ছোট ভাইদের হাফেজুল কুরআন ও আলেম বানাবেন। পরে বড় ভাইয়ের ইচ্ছাই পূর্ণতা পায়। ২০০৪ সালে মামুনুর রশীদ ও তার ছোট আবদুল্লাহ মারুফকে দিগলগাঁও গ্রামের মাআরিফুল কুরআন হাফিজিয়া মাদরাসায় নুরানি বিভাগে ভর্তি করে দেওয়া হয়। এ মাদরাসায় নুরানি-নাজেরা শেষ হলে তাদের দুজনকে মনতলা হামিউস সুন্নাহ মাদরাসায় ভর্তি করে দেওয়া হয়। কিশোর মামুন এখান থেকেই ২০০৯ সালে হিফজ সমাপ্ত করেন। হিফজ শেষ হলে তাকে মোমেনশাহীর প্রসিদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামেয়া আরাবিয়া মাখজানুল উলূমে ভর্তি করা হয়। তাইসির ও মিজান জামাত এখানে পড়েন। তারপর ২০১১ সালে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান থানার সৈয়দপুরের জামিয়া এমদাদিয়ায় নাহবেমিরে ভর্তি হন তিনি। এখানে এক বছর পড়ে ভর্তি হন দেশের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া কুরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগে। হেদায়াতুন্নাহু থেকে জালালাইন পর্যন্ত এই জামেয়ায় ইলম অর্জন করেন। এরপর জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদ থেকে ২০১৮ সালে তাকমিল (দাওরায়ে হাদীস) সমাপন করেন। এ বছরই রমজান মাসে হিন্দুস্তানে ইলমি রিহলা করেন। তিনি ১৪৩৯ হিজরির শাওয়ালের ১৭ তারিখে (পহেলা জুলাই ২০১৮) দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার ‘কুল্লিয়াতুল লুগাহ’য় (আরবি ভাষা অনুষদে) দাখেলা নেন। নদওয়ার বরকতময় পরিবেশে মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সাইয়েদ রাবে হাসানি নদভি রহ. ও আল্লামা সাইয়েদ বেলাল আব্দুল হাই হাসানি নদভির একান্ত তত্ত্বাবধান লাভ করেন। বরেণ্য আরবি সাহিত্যিক মাওলানা কায়সার হুসাইন মাদানি নদভির নিবিড় সান্নিধ্যে ধন্য হন। তা ছাড়া দারুল উলুম দেওবন্দ, ইমারতে শরিয়া বিহার, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি, মাওলানা আজাদ ইউনিভার্সিটিসহ হিন্দুস্তানের বিখ্যাত বিদ্যাপীঠে ইলমি সফর করে সেখানকার কয়েকজন উস্তাজের কাছে সীরাত, ইতিহাস, ইসলামি সাকাফাত ও আরবি সাহিত্যের বিশেষ সবক গ্রহণ করেন। বর্তমানে তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাবের অনুবাদ করেছেন। ইমাম ইবনে হাজম আন্দালুসি রহ.-এর জাওয়ামেউস সীরাহ, আল্লামা মুহিব্বদ্দীন তাবারি রহ.-এর খোলাসাতুস সিয়ারি সায়্যিদিল বাশার (সীরাতুন্নবী), আল্লামা ইবনে ফজলুল্লাহ উমরি রহ. রচিত মাসালিকুল আবসার ফি মামালিকিল আমসার গ্রন্থের ফি মামলাকাতিল হিন্দ ওয়াস সিন্দ অধ্যায়টি ‘সালতানাতে হিন্দ’ নামে অনুবাদ করেছেন। মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে আপাতত প্রকাশ হচ্ছে তার দীর্ঘদিনের গবেষণা ‘ইউরোপীয় রেনেসাঁয় মুসলমানদের এহসান’ নামক বইটি; এবং আরবি ভাষায় রচিত বাংলাদেশেরে ইতিহাস ‘দিরাসাত ও মাবাহিস ফি তারিখিল বাঙ্গাল’ (প্রকাশিতব্য) নামক বইটি। এগুলো ছাড়াও সীরাত, ইতিহাস, আরবিসাহিত্য ও সাকাফত প্রভৃতি বিষয়ে তার অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়ে আছে, শীঘ্রই সেগুলো আলোর মুখ দেখবে ইনশাআল্লাহ। অধ্যয়ন ও লেখালেখির মধ্য দিয়েই তার এখনকার সময় কাটছে। আল্লাহ তাআলা তার হায়াতে বরকত দান করুন! আমিন।