প্রবাসের ছিন্নপত্র ও আমার অনুভূতি আমি জানি, প্রবাসজীবনের প্রতিটি মুহূর্তে দেশের জন্য মনটা কাঁদে। দেশে রেখে যাওয়া মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধব ও চারপাশের প্রিয়জনদের জন্য যখন-তখন বুকের ভেতরটা হু হু করে ওঠে। এই বেদনা তীব্রভাবে অনুভব করেছিলাম আমার প্রবাসজীবনের দুটি বছরে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে থাকাকালীন এমন কোনো দিন নেই, যেদিন দেশ ও প্রিয়জনদের কথা আমি না ভেবেছি! এমন কোনো রাত নেই, যে রাতে দেশের স্বপ্ন আমি দেখিনি। এ কারণে প্রবাসী ভাই-বোনদের মনোবেদনা আমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি। প্রবাসজীবন আসলে এক পরাধীন জীবন। এই উপলব্ধি থেকেই জার্মানি থেকে ফিরে এসে ‘পরাধীনতা’ নামে উপন্যাস লিখেছিলাম। উপন্যাসটি প্রকাশের পর অনেক প্রবাসী আমাকে জানিয়েছেন, প্রবাসে যাওয়ার সময় উপন্যাসটি তারা হাতে করে নিয়ে যান। সেই দুই বছরের জীবনে ছুটির দিনগুলো ছাড়া প্রতিটি দিন প্রিয়জনদের চিঠি পাওয়ার আশায় থাকতাম আমি। রাত জেগে জেগে চিঠি লিখতাম প্রিয়জনদের। দুঃখ-বেদনা, বিষণ্নতা ও বিষাদে ভরা থাকত সেসব চিঠি। প্রবাসে একধরনের সচ্ছল জীবনে থেকেছি ঠিকই, কিন্তু সেই সচ্ছলতা আমাকে মোটেই আকর্ষণ করেনি। এখনকার পৃথিবী অনেক আধুনিক। মানুষের হাতে মোবাইল ফোন। সেকেন্ডের মধ্যে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলা যায়, ভিডিও কলে তাদের মুখটিও দেখা যায়। এ জন্য প্রবাসজীবন এখন অনেকটাই সহনীয়। আমার প্রবাসজীবনে পরিস্থিতি ছিল একেবারেই অন্য রকম। নিজেদের ঢাকার বাসায় টেলিফোন ছিল না। পাশের বাড়িতে গিয়ে মা ও ভাই-বোনরা বসে আছে আমার টেলিফোনের আশায়। তিন ঘণ্টা চেষ্টা করেও টেলিফোনে তাদের আমি কানেক্ট করতে পারিনি। চিঠিই ছিল যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম। সেই দিন একেবারেই বদলে গেছে। আজকাল চিঠি বলতে গেলে প্রায় লেখাই হয় না। এখন সব কাজই চলে টেলিফোনে। ভাবতে খুব ভালো লাগছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস করা কিছু সাহিত্যপ্রেমী মানুষ এখনো চিঠিপত্র লিখতে পছন্দ করেন এবং তারা ৫২ জন একত্র হয়ে ‘প্রবাসের ছিন্নপত্র’ নামে একটি বই প্রকাশ করছেন। ‘আরবান রিডার্স’ নামে তাদের একটা বই পড়ার সংগঠনও আছে। বইটি সম্পাদনা করেছেন কামরুল হাসান জনি। চিঠিগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতিচারণা আছে, মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে নিয়ে গভীর অহংকার ও তীব্র ভালোবাসা আছে। আছে মাতৃভূমির প্রতি প্রগাঢ় প্রেম, বাংলা ভাষার প্রতি প্রগাঢ় মমত্ববোধ। প্রেম-বিরহ, চাওয়া-পাওয়া, মা-বাবা, স্ত্রী ও সন্তানের জন্য বুকের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা গভীর থেকে গভীরতর অনুভবের কথা। আছে প্রেম ও বিরহের কথা। সব মিলিয়ে ‘প্রবাসের ছিন্নপত্র’ সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস করা বিভিন্ন স্তরের বাঙালির এক মর্মকথার দলিল। একসময় পত্রসাহিত্য খুব জনপ্রিয় ছিল বাংলা ভাষায়। আজকাল আর সেই চর্চাটি নেই। চিঠিপত্র লিখতেই ভুলে গেছে মানুষ। এই পরিস্থিতিতে প্রবাসের কঠোর কঠিন কর্মময় বাস্তবতার মধ্যে থেকেও ৫২ জন বাঙালি এই গ্রন্থটি রচনা করেছেন, ভেবে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। তারা সাহিত্যের চর্চাটি অব্যাহত রাখবেন আশা করি। ‘প্রবাসের ছিন্নপত্র’র প্রত্যেক লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন ও ভালোবাসা। ইমদাদুল হক মিলন কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার প্রধান সম্পাদক, দৈনিক কালের কণ্ঠ