কিছু বই আকারে ছোট, কিন্তু গুরুত্ব বিবেচনায় একাই একশো বইয়ের সমান। এ বইটি এমন বই। বাংলা ভাষায় এর প্রকাশনা একটি মাইলফলকও বটে। কারণ আধুনিক দর্শনের মৌলিক কাজ বাংলায় খুব দুর্লভ। দর্শনের ইতিহাস, গল্প, তত্বকথা ও অন্য দার্শনিকদের ওপর আলোচনা, এসবের বই দেখা যায় অনেক, কিন্তু দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ কাজের বই একেবারেই দেখা যায় না। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ এই ছোট্ট বইটির মাধ্যমে এ অভাব ঘুচিয়েছেন মনে করি। বইখানা পড়ার সময় বুঝা যায়— এর দেহ ছোট হলেও প্রাণ অনেক বড়। খুব সাবধানে বুঝে বুঝে পড়তে হয়। প্রতিটি লাইনে রাখতে হয় সতর্ক দৃষ্টি। তবে একবার পড়ে ফেললে মনে হবে, এ যেন এক নতুন ভাবনার জগৎ! আমরা যে-জগতে বাস করি, চারপাশে যা কিছু দেখি ও শুনি, তা সবই কি মিথ্যা? সবকিছুই কি সন্দেহজনক? কোনোকিছুই কি নিশ্চিত নয়? কোনো বিষয়েই কি নিশ্চিত জ্ঞান লাভের সুযোগ মানুষের নেই? এ প্রশ্নগুলো তখন জাগে। লেখক দেখিয়েছেন, তাঁর প্রিয় গরুটির বাস্তব অস্তিত্ব না-ও থাকতে পারে। গরুটি আছে কি না, আর মহাবিশ্ব আছে কি না, এ দুটি একই প্রশ্ন। মানুষের জ্ঞান লাভের ক্ষমতা যে সীমিত, মানুষ মহাবিশ্বকে যে-রূপে দেখে ও অনুধাবন করে, সে-রূপ যে মহাবিশ্বের না-ও থাকতে পারে, এ ইঙ্গিত মহিউদ্দিন মোহাম্মদ এ বইয়ে সুস্পষ্টভাবে দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, সাধারণ চোখে যা কিছু অকাট সত্য ও নির্ভুল মনে হয়, অসাধারণ চোখে তা খুব বিভ্রান্তিকর ও অনিশ্চিত। মহিউদ্দিন মোহাম্মদের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা যে কত প্রখর ও শক্তিশালী, তাঁর অন্তর্দৃষ্টি যে কতো গভীর, তা এ বইটি না পড়লে বুঝা যাবে না। সম্ভবত এ বইটিতেই তাঁর প্রতিভার আসল শক্তি উন্মোচিত হয়েছে। বইটি সায়েন্টিফিক ডগমাটিজমের প্রতি একপ্রকার হুমকিও বটে। মানুষের এমপিরিক্যাল নলেজ যে সবসময় নির্ভরযোগ্য ও অবজেক্টিভ নয়, জ্ঞানের যে একটি বাউন্ডারি রয়েছে, তা এ বইয়ে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ দেখিয়েছেন— মহাবিশ্বে হয়তো এমন অনেক জিনিস আছে, এমন অনেক ঘটনা হয়তো ঘটছে, যেগুলোর জ্ঞান আমরা উপযুক্ত অঙ্গের অভাবে নিতে পারছি না। বইটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ বাংলা ভাষায়, ও দ্বিতীয় ভাগ ইংরেজি ভাষায় রচিত। দ্বিতীয় ভাগটি সম্ভবত সাধারণ পাঠকদের জন্য নয়। ঐ ভাগে লেখক ‘সেনটিয়েন্স প্যারাডক্স’ ও ‘ডিজাইন সেট’ নামে দুটি নতুন দার্শনিক ধারণা হাজির করেছেন। লেখকের মতে, পদার্থের মৌলিক কণাগুলো কিছু নির্দিষ্ট ডিজাইন বা আকারে সন্নিবেশিত হলে সেখানে প্রাণের সঞ্চার ঘটতে পারে। গণিতবিদরা যদি কোনো প্রাণীর ‘ডিজাইন সেট’ হিসাব করতে পারেন, এবং বিজ্ঞানীরা ওই ডিজাইন সেট ব্যবহার করে যদি 3D বায়ো-প্রিন্টার বানাতে পারেন, তাহলে মানুষ কৃত্রিমভাবে বুদ্ধিমান প্রাণী বা জীব সৃষ্টি করতে পারবে। আমাদের বিশ্বাস, এ বইটি পড়ার পর চারপাশের জগৎ সম্পর্কে পাঠকদের দৃষ্টিভঙ্গীতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ পলিম্যাথ বা বহুধারার লেখক। প্রকাশিত প্রতিটি বইয়েই বাঙালির চিরায়ত চিন্তাভাবনাকে দিয়েছেন শক্তিশালী ধাক্কা। আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানের জনক ও বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত নোয়াম চমস্কি তাঁর লেখা পড়ে "Wise and challenging words" বলে মন্তব্য করেছিলেন। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে অধ্যাপক চমস্কির সাথে তাঁর এক ঘন্টার দ্বিপাক্ষিক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।