ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথা বাঙলা ভাষায় দর্শন শব্দটি প্রথমে কে বা করা ব্যবহার করেন, এবিষয়ে কোনো ঐতিহাসিক সুস্পষ্ট প্রমাণ আমাদের হাতে নেই একথা সত্যি।তাবে এর ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ফিলোসফি’ কথাটির ব্যবহারের মূলে যে খ্রিষ্টপুর্ব ষষ্ঠ শতকের গ্রিক চিন্তাবিদ পিথাগোরাস ছিলেন, সাম্প্রতিক গবেষণায় এবিষয়ে যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ রয়েছে।ব্যৎপত্তিগত দিক থেকে এই ফিলোসফি শব্দটির মূলে আছে ফিলস এবং সোফিয়া, যাদের বাঙলা অর্থ যথাক্রমে অনুরাগ বা প্রীতি এবং জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। কাজেই ব্যৎপত্তিগত দিক থেকে বিচার করলে ‘ফিলোসফি’-র বাংলা অর্থ দাঁড়ায় জ্ঞানপ্রীতি বা অনুরাগ।এ অর্থে যিনি জ্ঞান বা প্রজ্ঞার প্রতি আসক্ত, তিনিই প্রকৃত দার্শনিক পদবাচ্য। অন্যদিকে সংস্কৃত ‘দৃশ’ ধাতুর সঙ্গে ‘অনট’ প্রত্যয়ের সংযোগ থেকে বাংলা দর্শন শব্দটির উৎপত্তি। বাঙলা ভাষায় দৃশ ধাতুর অর্থ দেখা।কিন্তু এই দেখা মানে চাক্ষুষ প্রত্যক্ষণ নয়, এখানে দেখা শব্দটি তত্ত্বদর্শন তথা জীব ও জগতের স্বরূপোলদ্ধির সমার্থক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।তার মানে এখানে দেখা মানে ভাবনেত্রে তত্ত্বদর্শন। প্রকৃতপক্ষে বাঙলা ভাষায় জ্ঞানার্জনের যে শাখাটিকে আমরা দর্শন নামে আখ্যায়িত করি, তার আলোচ্যসূচি ও বিষয়বস্তুর সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় আখ্যায়িত ফিলোসফি’র আলোচ্যসূচির এই অনুপম সাদৃশ্যের দিকে লক্ষ রেখেই বঙ্গ-ভারতীয় পূর্বাচার্যেরা ফিলোসফির বাঙলা প্রতিশব্দ হিসেবে দর্শন শব্দটিকে জীবন ও জগতের এমন কিছু মৌলিক, অনুপম ও সার্বিক প্রশ্নের যৌক্তিক অনুসন্ধান করা হয়ে থাকে, যা জ্ঞানার্জনের অন্যকোনো শাখার চেয়ে তুলনামূলক বিচারে দর্শনের পরিধি স্বরূপতই ব্যাপক।জ্ঞানার্জনের অন্যান্য শাখা যেখানে বিশ্বভূবনের নির্দিষ্ট এক একটি বিভাগের আলোচনায় ব্যস্ত, দর্শন যেখানে সর্বাত্বক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে জীবন ও জগতের প্রতিটি মৌলিক বিষয় নিয়েই আলোচনা করে না। বিজ্ঞান জ্ঞানানুসন্ধানী কিন্তু জ্ঞান আদৌ সম্ভব কিনা, এ প্রশ্ন বিজ্ঞান তুলে না, কিন্তু দর্শনে এসবই তার আলোচ্যসূচির অন্তভূক্ত।দর্শনের চর্চা মানুষকে মুক্তবুদ্ধির অধিকারী করে।তাই দর্শন স্বাধীন চিন্তার ধারক ও বাহক।উপস্থাপিত দর্শনের মূলনীতি শীর্ষক গ্রন্থটি পাঠ করে যদি এই স্বাধীন চিন্তার মনোবৃত্তি অর্জনে কাউকে সাহায্য করে তাহলেই এ গ্রন্থের সার্থকতা। সূচিপত্র *১. অবরতণিকা *২. দর্শন ও অন্যান্য বিষয় *৩. দর্শন আলোচনার পদ্ধতি *৪. জ্ঞানতত্ত্ব *৫. জ্ঞানের স্বরূপ ও বিষয়বস্তু *৬. দেশ ও কাল *৭. জড় ও প্রাণ *৮. সৃষ্টিতত্ত্ব ও বিবর্তনবাদ *৯. মন বা আত্মা *১০. দেহ-মন সম্পর্ক বিষয়ক সমস্যা *১১. আত্মার অমরত্ব *১২. ইচ্ছার স্বাধীনতা *১৩. সত্তা সম্পর্কীয় সমস্যা *১৪. সত্যতার স্বরূপ ও মানদন্ড *১৫. মূল্যের স্বরূপ *১৬. ঈশ্বরের স্বরূপ *১৭. ঈশ্বরের অস্তিত্ব *১৮. অকল্যাণের স্বরূপ ও সমাধান
ডক্টর এম. মতিউর রহমান ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ অক্টোবর শ্রীভূমি সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা থানা সদরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে দর্শন বিষয়ে স্নাতক সম্মান (প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান) এবং ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে একই বিষয়ে স্নাতকোত্তর (প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতাস্থ সংস্কৃত প্রজ্ঞামহাবিহার থেকে ভারতীয় দর্শন ও বেদবিদ্যা পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান (ডিস্টিংশন-সহ) অধিকার করে দর্শনশাস্ত্রী উপাধি লাভ করেন। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক প্রবক্তা, সমকালীন ভারতের প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় পণ্ডিত মহামহােপাধ্যায় আচার্য ডক্টর শ্রীধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তী এম.এ, পি.এইচডি, শাস্ত্রী, বাচস্পতি প্রজ্ঞাভারতী, ভক্তিরত্ন, বাণীকণ্ঠ এবং ডক্টর সুনীলকুমার দাস এম.এ, এল.এল.বি, পি.এইচডি, ডি-লিট, তর্কতীর্থ মহােদয়দ্বয়ের যৌথ তত্ত্বাবধানে কলকাতাস্থ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমকালীন। ভারতীয় দর্শন তথা বাঙালির দর্শনচিন্তার উপর গবেষণা করে পি.এইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। ডক্টর রহমান ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের সারস্বত সাধনার অন্যতম পীঠস্থান গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনস্থ বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পােষ্ট ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ জুলাই ডক্টর রহমান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যােগদান করেন। তারপর তিনি ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যােগদানের মাধ্যমে নতুনভাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে প্রতীচ্য ন্যায়শাস্ত্র ও ভারতীয় দর্শনের অতিথি-বক্তা হিসেবেও কাজ করেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে অধ্যাপক এবং সংস্কৃত বিভাগে অথিতি-বক্তা হিসেবে কর্মরত। এছাড়া তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের অর্থানুকূল্যে পরিচালিত সাময়িকপত্রে বাঙালির দর্শনচিন্তা শীর্ষক প্রকল্পে গবেষণারত। তিনি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক একাডেমিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরিভাবে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ দর্শন সমিতি, বাংলা একাডেমী, এশিয়াটিক সােসাইটি অব বাংলাদেশ, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি এবং কলকাতাস্থ ভারতীয় দর্শনপীঠ, বঙ্গীয় দর্শন পরিষদ ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ- এর জীবন সভ্য হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।