"অপুর পাঁচালি" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি’ যে শুধু বাংলা চলচ্ছবি নয়, গােটা ভারতীয় চলচ্ছবিকেই রাতারাতি বয়স্ক করে তুলেছিল, এবং তার সামনে এঁকে দিয়েছিল এক নূতন পথের নিশানা, তা আমরা সবাই জানি। কীভাবে, কত বিঘ-বিপদ তুচ্ছ করে তােলা হয়েছিল এই ছবি, তারও কিছু-না-কিছু খবর রাখি। আমরা এবারে এই গ্রন্থে তার সামগ্রিক বিবরণ আমরা পাচ্ছি। শুধু ‘পথের পাঁচালি’ নয়, ‘অপরাজিত ও ‘অপুর সংসার’, এবং সেই সঙ্গে ‘পরশপাথর' ও ‘জলসাঘর’-এরও প্রস্তুতি-পর্ব ও নিমার্ণকালীন এমন নানা তথ্য এখানে স্বয়ং সত্যজিতের মুখে আমরা শুনছি, যে-বিষয়ে অনেক কিছুই এতকাল আমাদের জানা ছিল না। তাঁর চলচ্চিত্র তাে দেখেছি আমরা ; বস্তুত তাঁর প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রই আমরা অনেকে একাধিকবার দেখেছি। এখানে,—তাঁর ভাষা যেহেতু ছবি ফোটায়, তাই—সেই চলচ্চিত্রের নেপথ্যবর্তী চিত্রগুলিও তিনি আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে তিনি এখানে বলে যাচ্ছেন পাশ্চাত্য সংগীত ও চলচ্চিত্র-শিল্পের প্রতি তাঁর আকৈশাের অনুরাগের কথা, অন্য বৃত্তির প্রভূত সাফল্যকে হেলায় তুচ্ছ করে কীভাবে চলচ্চিত্রের জগতে চলে এলেন সেই কথা, প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও আপন লক্ষ্যে অবিচল থাকার কথা, এমনকি মাত্র আড়াইশাে টাকার অভাবে ‘পথের পাঁচালি’র শুটিং কীভাবে একদিন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, সেই কথাও। খুঁটিনাটি অজস্র তথ্যের মাধ্যমে সত্যজিৎ তাঁর আপন ব্যক্তিত্বকেই যেন এখানে আমাদের সামনে মেলে ধরেছেন। এক দিক থেকে এ-বই এক অন্তরঙ্গ স্মৃতিকথা, আবার অন্য দিক থেকে ঐতিহাসিক দলিলও বটে।
সত্যজিৎ রায় এক বাঙালি কিংবদন্তী, যিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারের খ্যাতি অর্জন করেছিলেন বিশ্বদরবারে। কর্মজীবনে একইসাথে চিত্রনাট্য রচনা, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, সম্পাদনা, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ, লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন অসম্ভব গুণী এই মানুষটি। ১৯২১ সালে কলকাতার শিল্প-সাহিত্যচর্চায় খ্যাতনামা এক বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার মসূয়া গ্রামে রয়েছে তাঁর পৈত্রিক ভিটা। ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি ‘লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে’ বা ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’ তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছিলো যে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের। প্রথম চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র জন্যই পেয়েছিলেন ১১টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, যার মধ্যে অন্যতম হলো কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘শ্রেষ্ঠ মানব দলিল’ পুরস্কার। তবে তাঁর কাজের সমালোচকও কম ছিলো না। এসব সমালোচনার উত্তরে লেখা দুটি প্রবন্ধ পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায় এর বই ‘বিষয় চলচ্চিত্র’-তে। কল্পকাহিনী ধারায় সত্যিজিৎ রায় এর বই সমূহ জয় করেছিলো সব বয়সী পাঠকের মন। তাঁর সৃষ্ট তুখোড় চরিত্র ‘ফেলুদা’, ‘ প্রফেসর শঙ্কু’ এবং ‘তাড়িনী খুড়ো’ যেন আজও জীবন্ত। একের পিঠে দুই, আরো বাড়ো এমন মজার সব শিরোনামে বারোটির সংকলনে লিখেছেন অসংখ্য ছোটগল্প। এছাড়াও সত্যজিৎ রায় এর বই সমগ্র’র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চলচ্চিত্র বিষয়ক ‘একেই বলে শ্যুটিং’, আত্মজীবনীমূলক ‘যখন ছোট ছিলাম’ এবং ছড়ার বই ‘তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম’। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘একাডেমি সম্মানসূচক পুরষ্কার' (অস্কার) প্রাপ্তি তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা অর্জন।