অন্যান্য প্রখ্যাত কথাশিল্পীদের মতো বনফুলও কবিতা রচনা করেই সাহিত্যের আসরে নেমেছিলেন। ছাত্রজীবনে কবিতার মাধ্যমে যখন তিনি সাহিত্যসৃজনে উদ্যোগী হয়েছিলেন, তখন সময় ও সমাজ তাঁর পৃষ্ঠপোষণা করেনি। তাই, শিক্ষকের নিষেধ অমান্য করতে বলাইচাঁদকে বনফুল নামে রূপান্তরিত করে তিনি নিজেকে বাংলা সাহিত্যের আসরে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন, কবিতা রচনা তাঁর কাছে সাময়িক বিলাস ছিল না। সমকালীন লেখকদের মধ্যে তারাশঙ্কর কবিতার একটি অতি সামান্য গ্রন্থের নমুনা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে এলেও অনতিকালের মধ্যেই কাব্যজগৎ থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় গ্রহণ করেছিলেন। চুয়ান্নটি গানের গীতিকার হলেও কবিতা আর কখনও তাঁর মনোহরণ করেনি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কবির জীবন নিয়ে একাধিক উপন্যাস লিখলেও এবং সামান্য কিছু কবিতা লিখলেও কবি হিসেবে তাঁর কিছুমাত্র স্বীকৃতি মেলেনি। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য-জীবনের দুই প্রান্তে মাত্র দু'খানি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা হলেও সেই বই দু'টির অকিঞ্চিৎকরত্ব পাঠকদের উদাসীন করে তোলে এবং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনন্যসাধারণ প্রকৃতিপ্রেমের ফলে বিশ্বপ্রকৃতির প্রতিটি রহস্য তাঁকে সম্মোহিত করেছে, বিস্ময়াবিষ্ট করেছে কিন্তু তাঁকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নিতে পারেনি। বরং প্রেমেন্দ্র মিত্র ও বুদ্ধদেব বসু শুধু কথাসাহিত্যিক-ই নন, কবি হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট সমাদৃত। কাব্যরচনার ক্ষেত্রে তাঁদের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য ছিল, তাই সমকালীনতার সীমা পেরিয়ে আজও তাঁরা বাঙালি পাঠক-সমাজে কবি হিসেবেও স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত। এমন কি, বুদ্ধদেবের গদ্যের অবয়বে কবিতার পেলব সুষমা সহজেই চোখে পড়ে। এদিক থেকে বিচার করলে বনফুল এঁদেরই স্বগোত্র। কিন্তু তাঁকে এঁদের সঙ্গে একশ্রেণীভুক্ত করা যায় না । দু'টি কারণে, তাঁর মৌলিকতা সহজেই চিহ্নিত হয়ে যায়। প্রথমত, তিনি কাব্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে যুগধর্ম মানেননি। ত্রিশের দশক থেকে শুরু করে বাংলা কবিতা যে একটি ভিন্নখাতে বইতে শুরু করেছিল, শব্দনির্বাচন উপমা উৎপ্রেক্ষা ও পদান্তমিল ছাড়াও কাব্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে নানারকম নতুন রীতি চালু হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট কবিরা রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতিও আদায় করেছিলেন, সেই ব্যাপারে বনফুলের সশ্রদ্ধ মনোযোগ ছিল না। বরং আধুনিক কবিতার প্রতি তিনি বিরূপই ছিলেন। মনে রাখতে হবে, নিজস্ব মৌলিকতা নিয়ে মোহিতলাল-সত্যেন্দ্রনাথ- যতীন্দ্রনাথ-নজরুল বাংলা সাহিত্যে কবি হিসেবে সপ্রশংস শ্রদ্ধা অর্জন করলেও এঁরা কিন্তু কাব্যসৃষ্টির বিবর্তনের ধারাকে নিয়ে কখনও বনফুলের মতো ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেননি। দ্বিতীয়ত, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বনফুলের কবি-সত্তা সর্বাংশে না হলেও অংশত ব্যঙ্গাত্মক মনোভাবে আচ্ছন্ন ছিল। গল্প-উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে তাঁর বিদ্রূপাত্মক মনোভঙ্গি করুণরসে নিষিক্ত হত। সেখানে ব্যঙ্গের চাবুকে তিনি সমাজকে কদাচিৎ কষাঘাত করেছেন। কিন্তু কবিতা-রচনার ছোট পরিসরে সমাজ ও জীবনের অসংখ্য বিষয় নিয়ে তিনি যে-সব কবিতা লিখতেন, সেখানেই ফুটে উঠত তাঁর মর্মভেদী বক্তব্য যা একরোখা, শাণিত, ক্ষুরধার, ব্যঙ্গবৈদগ্ধ্যে উজ্জ্বল । বনফুল তাঁর সুদীর্ঘ সাহিত্য-জীবনে কবিতা রচনা থেকে নিজেকে কখনও সরিয়ে আনেননি। বিভিন্ন বিষয় তাঁর কবিতায় উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৩৬ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হলেও সত্তরের পরেও তিনি নানাবিষয় নিয়ে বেশ কিছু কবিতা লিখেছেন। সমাজ ও জীবন সম্পর্কে বঙ্কিম দৃষ্টির অধিকারী হলেও প্রেমেন্দ্র মিত্র কিন্তু ব্যঙ্গ-কবিতা লেখেননি, আবার জীবন-সম্পর্কে যে তির্যক, বিশ্লেষণী, ক্ষুরধার ও মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে সার্থক ব্যঙ্গ-কবিতা লেখা যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের তা থাকলেও তিনি কথাসাহিত্যের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে কখনও কাব্যরচনায় তাঁর প্রতিভাকে নিয়োজিত করতে চাননি । বনফুলের শিল্পিসত্তাকে কবিতা চিরকালই প্রাণিত করেছে, সাহিত্যসৃজনের প্রথমাবধি কবি- মন কখনই তাঁকে ছাড়েনি। তাঁর ‘মৃগয়া' উপন্যাসের একটি অংশই তো কবিতায় লেখা, কবিতা আকীর্ণ হয়ে রয়েছে তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'তৃণখণ্ড তে, কবি হিসেবে বারংবার বনফুল আবির্ভূত হয়েছেন ‘বৈতরণীর তীরে ও ‘ডানা' উপন্যাসে। সারাজীবন ধরে তিনি অসংখ্য কবিতা লিখেছেন বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে। কিন্তু যখনই তিনি ব্যঙ্গ-কবিতা লিখতে কলম ধরেছেন, তখনই আমরা যেন তাঁর শিল্পিমানসের সোল্লাস স্বতঃস্ফূর্ততা লক্ষ্য করি। নানাবিষয়ে লেখা অসংখ্য কবিতার পাশাপাশি ব্যঙ্গকবিতা বনফুলকে কৈশোর থেকেই আকৃষ্ট করেছে। আই. এস সি. ক্লাসের ছাত্রহিসেবে শিক্ষকের নির্দেশে ক্লাসে বসেই ‘গরু - সম্বন্ধে রচনা লেখেন কবিতার আঙ্গিকে এবং কবিতাটিতে মৌলিকতাও ছিল। অতঃপর বিজ্ঞানের ছাত্র যখন মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হিসেবে ভর্তি হলেন তখন কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর যে-সব কবিতা ছাপা হতে থাকে, সেগুলোর মধ্যে সমাজ-জীবন সম্পর্কে অসংখ্য ব্যঙ্গ-বিদ্রূপাত্মক কবিতা ছিল। তাই, সাতাশ সালে ডাক্তারি পাশ করে তিনি যখন দু'বছর পরে ভাগলপুরে গিয়ে চিকিৎসক হিসেবে তাঁর কাজ শুরু করলেন, তখন তিনি কলকাতা ত্যাগ করলেও কলকাতা তাঁকে পরিত্যাগ করল না, শনিবারের চিঠি'র সম্পাদক পরিমল গোস্বামী ভাগলপুরে গিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপমূলক কবিতা সংগ্রহের জন্য ওঁর শরণাপন্ন হলেন কারণ ততদিনে তাঁকে হাস্যরস পরিবেশনের জন্য ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনা করা শুরু হয়েছিল।
আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় । জন্ম: ১৯ জুলাই, ১৮৯৯ সালে। তিনি একজন বাঙালি কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও কবি। তিনি বনফুল ছদ্মনামেই অধিক পরিচিত। অবিভক্ত ভারতবর্ষের বিহার রাজ্যেরমনিহারীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের পিতার নাম ডা. সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ও মাতা মৃণালিনী দেবী। তাদের আদি নিবাস হুগলী জেলার শিয়াখালা। কিন্তু তিনি বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মণিহারী গ্রামে জন্মগ্রহণ । প্রথমে মণিহারী স্কুলে এবং পরে সাহেবগঞ্জ জেলার সাহেবগঞ্জ উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে তিনি লেখাপড়া করেন। শেষোক্ত স্কুল থেকে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা (এন্ট্রান্স) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি আই.এস.সি, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হাজারীবাগ সেন্ট কলম্বাস কলেজ থেকে। কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন তবে পাটনা মেডিক্যাল কলেজে থেকে এম.বি, ডিগ্রী লাভ করেন। প্যাথলজিস্ট হিসাবে ৪০ বৎসর কাজ করেছেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন। শিক্ষকদের কাছ থেকে নিজের নাম লুকোতে তিনি বনফুল ছদ্মনামের আশ্রয় নেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে সাহেবগঞ্জ স্কুলে পড়ার সময় মালঞ্চ পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটে। নিয়মিত প্রবাসী, ভারতী এবং সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকায় ছোটগল্প প্রকাশ করেন। লেখক হিসেবে বনফুল হাজারেরও বেশি কবিতা, ৫৮৬টি ছোট গল্প, ৬০টি উপন্যাস, ৫টি নাটক, জীবনী ছাড়াও অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তাঁর রচনাবলীসমগ্র ২২ খণ্ডে প্রকাশিত। তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি 'পদ্মভূষণ' উপাধি লাভ করেন। এছাড়াও তিনি শরৎস্মৃতি পুরস্কার (১৯৫১), রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৬২), বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জগত্তারিণী পদক (১৯৬৭)। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট উপাধি প্রদান করে ১৯৭৩ সালে। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি তারিখে কলকাতা শহরে তাঁর মৃত্যু হয়।