”বুদ্ধদেব গুহর ছােটগল্প” বইয়ের ফ্ল্যাপে লিখা কথা ‘বুদ্ধদেব গুহর ছােটগল্প’—এই শব্দবন্ধের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে অপ্রতিরােধ্য এক চুম্বক । এমন মায়াময় আকর্ষণ, যা কিনা সব বয়সী পাঠক-পাঠিকাকেই করবে প্রলুব্ধ। তার কারণ, ছােটগল্প বলতে কখনও এমন কোনও লেখার কথা ভাবেন না বুদ্ধদেব গুহ, যার মধ্যে গল্প ব্যাপারটাই অনুপস্থিত। তিনি জানেন, এবং লিখিতভাবেও কবুল করেছেন যে, কোনও গল্প-উপন্যাসই নিছক বিশেষ কিছু নরনারীর কাহিনী নয়। যাদের নিয়ে গল্প, তারা প্রত্যেকেই আরও বহুর প্রতিভূ। তাদের মুখ দিয়ে, তাদের। আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে, শুধু তাদেরই কথা শােনাতে চান না একজন সৎ লেখক, একই সঙ্গে তিনি তুলে ধরেন আরও অনেকের কথা । এক-একটি যুগের কথা, প্রজন্মের কথা, সময়-সমাজ পরিপার্শ্বের কথা । বুদ্ধদেব গুহ একথাও জানেন যে, মানুষের জীবনে নানারকম ঘটনা রােজই ঘটে এবং তটরেখার মতাে তা মুছেও যায় । সেইসব ঘটনাকেই চিরস্থায়ী আনন্দের, দুঃখের অথবা গভীর অনুভবের করে তােলে সাহিত্য । নিজের এই বিশ্বাস ও ধ্যানধারণাকে লেখার মধ্যেও ভারি সূক্ষ্মভাবে মিশিয়ে দেন তিনি। আর তাই, তাঁর প্রতিটি গল্প-উপন্যাস হয়ে ওঠে। বহুমাত্রিক এবং কোনও-না-কোনও দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। এইরকমই একগুচ্ছ সাম্প্রতিক গল্প নিয়ে এই সংকলন। দু-ডজনেরও বেশি গল্প এই বইতে। নানা মাপের, নানা স্বাদের, নানা রসের । এমনকী, ‘বোঁদেদা’ বা ‘গোঁসাঘর (প্রাঃ) লিমিটেড'-এর মতাে কৌতুকরঙীন বিপুলভাবে সমাদৃত গল্পগুলিও বাদ যায়নি। তবে হাসির গল্পই হােক, কিংবা রােম্যান্টিক গল্প, কিংবা হােক জীবনের আনন্দ-বেদনা অনুভব-উপলব্ধির খণ্ড মুহুর্তের জীবন্ত প্রতিচিত্রণ, বুদ্ধদেব গুহর গল্পের সব-ছাপানাে উদ্দেশ্যটি কখনও অস্পষ্ট থাকে না। উচ্চবিত্ত সমাজকে যেমন কাছ থেকে দেখার সুযােগ ঘটেছে তাঁর, মধ্যবিত্ত সমাজকেও তেমনই ভিতর থেকেই চেনেন তিনি। তাই এই দুই সমাজেরই অন্তঃসারশূন্যতা ও অসঙ্গতি, নব্য নগরসভ্যতার ইদুর-দৌড়ে সামিল হবার অন্ধ অপচেষ্টা, কৃত্রিম সাহেবিয়ানা, সম্পর্কের ফাটল, মূল্যবােধের বদল, মুখ আর মুখােশের দ্বন্দ্ব নানাভাবে ঘুরে-ফিরে দেখা দেয় তাঁর গল্পে। প্রকৃত-অর্থে সচেতন এক লেখকের মতাে এই দিকগুলাে সম্পর্কেই সাবধান করে দিতে চান তিনি। দেন নানান মােড়কে মুড়ে।
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।