ফ্ল্যাপে লিখা কথা বালিকাকন্যা ইন্দিরার উদ্দেশে রচিত পিতা জওহরলাল নেহরুর পত্রাবলির একটি হ্রস্বায়তন সংকলন এমনই তুমুল জনপ্রিয় যে, আমরা অনেক সময়ই ভুলে থাকি সর্বার্থে বড় এই গ্রন্থটির কথা, যার পোশাকী নাম ‘গ্লিমসেস অভ ওয়ার্লড হিস্ট্রি’ বা ‘বিশ্ব-ইতিহাস প্রসঙ্গ’। এগ্রন্থটিও একইভাবে রচিত হয়েছিল কন্যা ইন্দিরার উদ্দেশ্যে কারান্তরাল থেকে প্রেরিত পিতা নেহরুর পত্রধারার মাধ্যমে। কিন্তু ব্যক্তি সমসময়কে ছাপিয়ে এগ্রন্থের আবেদন এমনই সর্বজনীন ও সর্বকালীন যে, ফিরেফিরেই পড়তে হয় এই পত্রাবলি, পুরাতন কালকে আবিষ্কার ও পুরাতনের সঙ্গে নূতনের সম্বন্ধ নির্ণয় করতে গিয়ে যেখানে নেহরু অভিযান চালিয়েছেন অতীতের মহাসমুদ্রে, বিভিন্ন কালে বিভিন্ন যুগে ইতিহাসপ্রসিদ্ধ নবনারীর প্রতিবেশী হয়ে করেছেন বসবাস, কোথঅও আবার অতীতের ঘটনা ভালভাবে হৃদয়ঙ্গম করার জন্য পুরাতনের জীর্ণ কঙ্কালকে রক্তমাংস দিয়ে জীবন্ত রূপে সাজিয়ে তুলেছেন। ‘গ্লিমসেস অভ ওয়ার্লড হিস্ট্রি’ গ্রন্থের পরিচিতি দিতে গিয়ে ১৯৩৯ সালের মে মাসে ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন লিখেছিলেন, এ বই- “ঘটনার বিবরণী মাত্র নয়। বিবরণের দিক থেকে এ-গ্রন্থ যেমন মূল্যবান, তেমনই লেখকের ব্যক্তিত্বের ছাপও হতে বর্তমান। তাঁর (হেহরুর) অসাধারণ মনীষা ও অনুভূতিপ্রবণ মন এই ইতিহাস-গ্রন্থকে অনন্যসাধারণ করে তুলেছে। বর্ধিষ্ণু শিশুর উদ্দেশ্যে লিখিত পত্রের আকারও এতে ক্ষুণ্ন হয়নি। এর আবেদন সরল এবং ঋজু। কিন্তু, বিষয়বস্তুর আলোচনা কোথাও অগভীর নয়। ঘটনার বিবৃতি বা তাৎপর্য বিশ্লেষণ কোথাও অতিমাত্রায় সরলীকৃত হয়নি।”
এ-কথা সেনি যেমন সত্য ছিল, আজও তেমনই সত্য। আর তাই, নেহরু-জন্ম শর্তবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি হয়ে আবার প্রকাশিত হল ‘বিশ্ব ইতিহাস প্রসঙ্গ’।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ও স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ব্যারিস্টারি পেশা ছাড়াও আরেকটি পরিচয় আছে। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশই নয়, বিশ্বপাঠকের কাছে তিনি একজন সমৃদ্ধ লেখক। পণ্ডিত নেহরু এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন, ১৮৮৯ সালের ১৪ই নভেম্বর। পনেরো বছরের কিশোর নেহরু বিলেতে পাড়ি জমান, প্রাথমিক শিক্ষার পরের পাটটা বিলেতেই সম্পন্ন হয়। বিলেতে তিনি পড়াশোনা করেছেন হ্যারো ও কেম্ব্রিজে। পড়াশোনা শেষ করার পর পেশা হিসেবে বেছে নেন ব্যারিস্টারিকে। তিনি দেশে ফেরেন ১৯১২ সালে। ফেরার পরই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, সেসময় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। অনেকদিন বিদেশে থাকার ফলে অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সফলতার মুখ দেখবার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়েন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়টাতে দু’বার কারাবরণও করেন নেহরু। মহাত্মা গান্ধী দ্বারা তিনি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। জওহরলাল নেহরু এর বই সমগ্র পড়লে তাঁর ব্যক্তিজীবনের দর্শন, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অনেকটাই জানতে পারা যায়। কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর ছোটবেলায় তাঁর কাছে কিছু চিঠি লিখেছিলেন নেহরু। সে চিঠিগুলো পরে বই আকারে প্রকাশ পায়, ‘লেটারস ফ্রম অ্যা ফাদার টু হিজ ডটার’ নামে; যা পরবর্তীতে বাংলা ভাষায় ‘বাবার চিঠি’, ‘মেয়ের কাছে বাবার চিঠি’ বা ‘কল্যাণীয়াসু ইন্দু’ নামে অনূদিত হয়েছে। শিশু-কিশোরবান্ধব এই বইটিতে পৃথিবীর ইতিহাস, দর্শন সম্পর্কে সহজ ভাষায় অনেক কিছু বলা হয়েছে যা কি না অনেক কম বয়সেই শিশুদের মনের দরজা-জানালা খুলে দিতে ভূমিকা রাখতে পারে। জওহরলাল নেহরু এর বই সমূহ সাধারণত ইতিহাসকেন্দ্রিক ও তাঁর রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত। ‘পৃথিবীর ইতিহাস’, ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’, ‘টুওয়ার্ড ফ্রিডম’ বইগুলো তাঁর বেশ বিখ্যাত লেখনীর অন্তর্ভুক্ত। এসব বইয়ের তালিকায় তাঁর আত্মজীবনীও রয়েছে।