ভূমিকা মেসবাহ কামাল ভূমিকা ভৌগোলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবেচনায় যে ভূখণ্ডটি ‘বঙ্গদেশ’ বা ‘বাংলা' হিসেবে চিহ্নিত, ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে তার বিভাজন “সম্পূর্ণ পৃথক রাজনৈতিক বিকাশের সূচনা করেছে এবং নির্মাণ করেছে দুটি ভাগে বিভাজিত এক নতুন আঞ্চলিক পরিচিতি। দু’বাংলাকে ‘একাঙ্গবদ্ধ যমজ' (Siamese twins) রূপে দেখা যেতে পারে, যাদের পৃথক করা হয়েছে এবং যারা নিজের পৃথক পরিচিতিকে প্রতিষ্ঠা করেছে। তবে এই পৃথকতু বা স্বাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ১৯৪৭ উত্তরকালের বিষয়। জনসমাজের গঠন এবং ১৯৪৭ পূর্ববর্তী সময়কালের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও অর্থনীতি পর্যালোচনায় গোটা বঙ্গদেশকে একটি একক সত্তা হিসেবে দেখার কোনো বিকল্প নেই। আর এখন ‘বঙ্গদেশকে (বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে) সাধারণভাবে দেখা হয় সম-সংস্কৃতির এলাকা হিসেবে, যেখানে কেবল বাংলা ভাষারই প্রচলন এবং বসবাস করেন কেবল বাঙালিরা। কিন্তু এ চিত্রায়ন মাঠ পর্যায়ের যে বাস্তবতা তার প্রতিফলন নয়। বাঙালির বাইরেও দু’বাংলাতেই এমন বেশ কিছু জাতির মানুষ বাস করেন, যারা নিজেদের 'বাঙালি' বলে মনে করেন না এবং অন্যদের কাছেও ‘বাঙালি' হিসেবে বিবেচিত হন না। যদিও এসব মানুষের অধিকাংশই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলায় কথা বলেন, তাদের বেশির ভাগেরই নিজেদের ভিন্ন মাতৃভাষা রয়েছে। তাদের সংস্কৃতিও পৃথক এবং ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকে তারা নিজেদের পৃথক পরিচয় দেন। এ গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় বাঙালি ভিন্ন সেসব জাতিসমূহ, বিশেষত তারা যারা নিজেদের পরিচয় দেন, অথবা একসময়ে পরিচিত ছিলেন, আদিবাসী হিসেবে। আদিবাসীর সংজ্ঞা ‘আদিবাসী' শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। ‘আদি’ অর্থ মূল’ এবং বাসী’ অর্থ অধিবাসী। সুতরাং আদিবাসী কথাটির অর্থ ধরা যায় দেশীয় লোক’ (Indigenous People) হিসেবেও। ইদানিংকালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষত ভারতে আদিবাসীর একটি প্রতিশব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, যাকে জনপ্রিয় করার জন্য প্রচেষ্টাও চলছে, সেটি হলো “বনবাসী” (forest dwellers)। এদের অনেকের বসবাস বনকেন্দ্রিক। তবে বাংলাদেশের সমতলের জন্য ব্যাপারটা এখন ভিন্ন। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা মূলত বরেন্দ্র ভূমির বাসিন্দা এবং বনবাসী নন, ‘লোকালয়ের অধিবাসী। তবে অন্যান্য স্থানের আদিবাসীদের মতো তারাও নিজস্ব বা আদি-অধিবাসীর মতানুসারে জীবনযাপন করছেন। কিন্তু তাদের স্বাতন্ত্র, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আলাদা জীবনযাত্রাকে অস্বীকার করার একটি প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন বিশ্লেষণে। আদিবাসী বলতে বোঝায় এমন একটি জনগোষ্ঠী যারা মোটামুটিভাবে একটি অঞ্চলে সংগঠিত, যাদের মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক ঐক্য এবং যার সদস্যরা মনে করেন যে তারা একই সাংস্কৃতিক এককের অন্তর্ভুক্ত।
Title
বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা - ৫: আদিবাসী জনগোষ্ঠী
Mesbah Kamal- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। ইতিহাস ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সমাজবিজ্ঞান ও সমাজনীতি নিয়ে দেশে ও বিদেশে পড়াশোনা করেছেন। গত ১৪ বছর ধরে গবেষণা করছেন মূলত আদিবাসীদের নিয়ে। বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সাংবিধানিক স্বীকৃতি আদায় এবং জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের মানবাধিকার ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি একজন অগ্রণী সংগঠক। ছাত্র-জীবনে প্রগতিশীল ছাত্র-রাজনীতির পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও সাংবাদিকতার সাথে। পরবর্তীতে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে সংবাদ প্রযোজক ও পরিবেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘদিন। দেশে ফিরে গড়ে তুলেছেন নীতি-নির্ধারণী গবেষণা ও জাতীয় পর্যায়ে এ্যাডভোকেসীর জনমুখী প্রতিষ্ঠান ‘গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ’ (জউঈ)। সেইসাথে ভূমিকা রাখছেন বাংলাদেশ আদিবাসী অধিকার আন্দোলন-এর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে। প্রকাশিত গ্রন্থাবলী চিমনীর মুখে শোন সাইরেন শঙ্খ : পূর্ব বাংলায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের বিকাশ-বৃত্তান্ত, দিনাজপুরের তেভাগা আন্দোলন: প্রস্তুতিপর্ব, নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ : সমকালীন রাজনীতি ও ইলা মিত্র, অশ্র“-সাগরে মিলিত প্রাণ : মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ও চা জনগোষ্ঠী, আদিবাসী জনগোষ্ঠী (বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সমীক্ষামালা, ৫ম খণ্ড), Indigenous Communities (Cultural Survey of Bangladesh, Vol 5), মৃত্যু নাই, নাই দুঃখÑআছে শুধু প্রাণ : নাসরীন হকের প্রতি নিবেদিত বক্তৃতামালা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান : শহীদ আসাদ ও শ্রেণী-রাজনীতি প্রসঙ্গ, নিজভূমে পরবাসী : উত্তরবঙ্গের আদিবাসীর প্রান্তিকতা ডিসকোর্স, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা (প্রথম খণ্ড), শতাব্দীর সাথে সাতচল্লিশ বছর : মোহাম্মদ হাফিজুর রহমানের আত্মকথা, Reflections on Diversity and Citizenship: Bangladesh and Beyond, Unbroken Silence: A Participatory Study on Indigenous Society, Santal Community in Bangladesh : Problems and Prospects, পার্বত্য চট্টগ্রাম : সংকট ও সম্ভাবনা, ক্ষুদ্র ঋণ : বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা, শ্রেণী-দৃষ্টিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। আরিফাতুল কিবরিয়া (মুন্নী) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন সমাজবিজ্ঞানে এবং তাঁর আগ্রহ আদিবাসী ও নারীসহ সমাজের সব বঞ্চিত জনগোষ্ঠী পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত। গবেষণা করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব, নারীর ক্ষমতায়নের সরকারি আখ্যানের বিপরীতে আদিবাসী নারীর হাল এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে। গবেষণা ও উন্নয়ন কালেকটিভ (RDC)-এর সাথে কর্মসূত্রে যুক্ত। বর্তমানে চীনের বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি পর্যায়ে গবেষণা করছেন। এটি তাঁর প্রথম গ্রন্থ।