"জীবনের জলছবি" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: অস্তাচলের ধারে পৌঁছে পূর্বাচলের দিকে ফিরে তাকিয়েছেন প্রতিভা বসু। বিপুল ঘটনাকীর্ণ তাঁর জীবন। আয়ুর যে-পথ ধরে হেঁটে এসে জীবনের উপান্তে এসে পৌঁছেছেন তিনি, শুধু দীর্ঘই নয় সেই পথ, বহু চড়াই-উতরাইতেও ভরা। পিছনের দিকে আজ যখন তাকিয়ে দেখছেন প্রতিভা বসু, তাঁর মনের পরদায় ফুটে উঠেছে সুদীর্ঘ যাত্রাপথের অসংখ্য বাঁক, একের পর এক উজ্জ্বল, রঙিন জলছবি। সেই জলছবিরই আশ্চর্য অ্যালবাম এই বই, জীবনস্মৃতির এই উজ্জ্বল উদ্ধার। যাঁদের জীবনস্মৃতি শুধু তাঁদের জীবনেরই কথা নয়, একই সঙ্গে সেই জীবনের সঙ্গে জড়ানাে আরও বহু বর্ণময় জীবনেরও কিছু কিছু অজানা কথা, প্রতিভা বসু তাঁদেরই একজন। জীবনের যে-সমূহ জলছবি এই গ্রন্থে, তার প্রতিটির কেন্দ্রে তিনি। পাশাপাশি, যেমন দুর্লভ এইসব ছবিতে ধরা-পড়া এক ব্যাপ্ত সময়ের চালচিত্র, তেমনই কৌতূহল-জাগানাে তাঁর আশেপাশে ছড়িয়ে-থাকা চেনা-অচেনা অজস্র মুখ। মূল্যের থেকেও তাই ঢের বেশি মূল্যবান এই আত্মস্মৃতিগ্রন্থ। এই স্মৃতিকথার সূচনা প্রতিভা বসুর অবােধ শিশুবয়স থেকে। আর পরিসমাপ্তি—প্রবােধ-অসাধ্য পুত্রশােকের তীব্রতা যখন তাঁর নিভৃত প্রহরের একান্তসঙ্গী। মধ্যবর্তী সময়সীমায় ছড়িয়ে রয়েছে। উপন্যাসের থেকেও আকর্ষক এক জীবনকাহিনী। সে কাহিনীতে রয়েছে রাণু সসাম নামে। বালিকাবয়সেই সুখ্যাত ও গ্রামােফোন কোম্পানির নিয়মিত সঙ্গীতশিল্পী হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত, দিলীপকুমার রায়, নজরুল ইসলাম, হিমাংশু দত্ত, এমন-কি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছেও সঙ্গীতশিক্ষার আছে প্রতিভা সােম নামে লেখিকা-সত্তার আত্মপ্রকাশের, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে আলাপ, প্রণয় ও পরিণয়ের, সাংসারিক জীবনের খুঁটিনাটির বিবরণ। এসেছে সমকালীন ডাকসাইটে কবি-সাহিত্যিকদের কথা, কবিতাভবনের আর কথা, তরুণতর লেখকগােষ্ঠীর কথা। আছে ঢাকা, কলকাতা, একাধিক মফস্বল শহর আর বিদেশের কথা। আছে নানা ক্ষেত্রের জ্ঞানী-গুণী, স্মরণীয় ও বরণীয়দের প্রসঙ্গ। শুধু বিষয়গরিমাতেই গরীয়ান। নয় জীবনের জলছবি', রচনাভঙ্গিতেও তুমুল আচ্ছন্নকর। এমন আন্তরিক, এমন মূল্যবান, এমন অন্তরঙ্গ এবং এমন অকপট আত্মস্মৃতি বাংলা ভাষাতেই যেন বিরল।
জন্ম ১৩ মার্চ, ১৯১৫ । তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও প্রাবন্ধিক। প্রতিভা বসু অবিভক্ত বাংলার (অধুনা বাংলাদেশের) ঢাকা শহরের অদূরে বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবার নাম আশুতোষ সোম ও মায়ের নাম সরযূবালা সোম। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে বিবাহের আগে তিনি রাণু সোম নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর দুই মেয়ে মীনাক্ষী দত্ত ও দময়ন্তী বসু সিং এবং এক ছেলে শুদ্ধশীল বসু। শুদ্ধশীল বসু মাত্র ৪২ বছর বয়সে মারা যান। প্রতিভা বসুর দৌহিত্রী কঙ্কাবতী দত্তও একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক। প্রতিভা বসু পশুপ্রেমী ছিলেন। প্রতিভা বসু'র অধিকাংশ বই বাণিজ্যিকভাবে সফলতার মুখ দেখে। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়ণ হয় ও ব্যাপক সফলতা পায়। গান করার পাশাপাশি লিখতে শুরু করেন। প্রতিভা বসু'র জনপ্রিয়তা এমনই ছিল যে বই বিক্রেতা এবং প্রকাশকদের মধ্যে বই প্রকাশ ও বিতরণ নিয়ে ঝগড়ারও ঘটনা ঘটে। বাংলা ভাষায় অনন্য অবদানের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়াও, সাহিত্যকর্মে সবিশেষ অবদানের জন্য আনন্দ পুরস্কারে ভূষিত হন। মৃত্যু ১৩ অক্টোবর, ২০০৬সালে।