কথারম্ভ বিজ্ঞানের উন্নতি ও নানা আবিষ্কারের ফলে আজ আমাদের কত সুবিধাই না হয়েছে। আমরা ট্রেনে চেপে হুস করে অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিতে পারছি। আকাশ পথে প্লেনে চেপে হিল্লি-দিল্লি, লন্ডন-প্যারিস ঘুরে বেড়ানোও আজ কত সহজ। আমরা প্রিয়জনের সঙ্গে টেলিফোনে মুহুর্তের মধ্যে সুখ-দুঃখের কথা বলছি, বাড়ির সকলের সঙ্গে আনন্দ-কোলাহল করে রেডিও-টিভি-র প্রোগ্রাম দেখছি। দারুণ গ্ৰীষ্মে ফ্রিজ খুলে আইসক্রিম খেতে খেতে ফ্যানের সুইচটা অন্য করতেই— আঃ, তখন কী আরাম অথবা এয়ার কন্ডিসনড় মেশিনটা চালিয়ে দিতে পারলে তো আর কোনও কথাই নেই। ঘরের মধ্যেই তখন কী দারুণ হিমশীতল পরিবেশ— ভারী মজার ব্যাপার, তাই না ? আবার ঠাণ্ডা লেগে সর্দি-কাশি-জ্বর হয়েছে, ডাক্তারবাবুর কাছে যাওয়া মাত্রই উনি তক্ষুনি ওষুধ লিখে দেবেন। মাত্র কয়েকটা ট্যাবলেট মুখে দিলেই হােল, আর কথাটি নেই, কয়েক দিনের মধ্যেই একেবারে চাঙা হয়ে তুমি মাঠে ফুটবল অথবা ক্রিকেট খেলতে নেমে পড়বে। একবিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রাস্তে এসে আজ আমাদের বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারগুলো কত সহজ ও স্বাভাবিক বলে - মনে হয় । কিন্তু সত্যি সত্যি তো আর ব্যাপারটা তত সহজ ছিল না । মনে রাখতে হবে এইসব আবিষ্কারের পিছনে রয়েছে বহু বিজ্ঞানীর বহুদিনের কঠোর সাধনা, অধ্যবসায় ও নিষ্ঠ । প্রকৃতপক্ষে উনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলি দারুণ চমকপ্রদ তো বটেই এমন কি গল্পের চেয়েও অদ্ভুত । এই সময়কার বিজ্ঞানীদের কাছে খুব বেশি সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি ছিল না । কিন্তু একথা সত্যি যে তাঁদের সকলেরই জীবনসংগ্রামে জয়ী হবার এক অদম্য বাসনা ছিল । আসলে বিদ্যুতের আবিষ্কারই মানুষের সভ্যতাকে ঠেলে দিয়েছে অনেকখানি । প্ৰাচীন বিজ্ঞানীদের অদম্য কর্মনিষ্ঠা ও অধ্যবসায় আমাদের মনে আজও গভীর শ্রদ্ধা ও বিস্ময় উদ্রেক করে। অবশ্য এই গ্রন্থে শুধুমাত্র উনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথাই বলা হয়নি। সুদূর অতীতকালের বিজ্ঞানী যেমন আর্কিমিডিস থেকে শুরু করে নিউটন, আইনস্টাইন এমন কি আমাদের দেশের অনেক বরণীয় বিজ্ঞানীর স্মরণীয় আবিষ্কারের কথা গল্পের মতো হৃদয়গ্রাহী করে কিশোর-কিশোরীদের জন্য লেখা হয়েছে। আমার ছােট্ট বন্ধুদের ছেলেবেলা থেকেই যাতে একটা বৈজ্ঞানিক মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে, প্রতিভাধর বিজ্ঞানীদের প্রতি তারা গভীর শ্রদ্ধাশীল হয়, তাঁদের কঠোর শ্রম ও আত্মত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হতে পারে— এই উদ্দেশ্য নিয়েই গ্রন্থটি রচনা করেছি। আজকের এই নবীন পাঠকের মধ্যেই হয়ত ভাবী বিজ্ঞানীর সুপ্ত সম্ভাবনার সোনালী বীজ নিহিত আছে। সত্যি কথা বলতে কি, একবিংশ শতাব্দীর নবযুগও এই ভাবী বিজ্ঞানীকে বরণ করবার জন্য উৎসুক নয়নে যে চেয়ে রইবে- এমন আশা করা নিশ্চয়ই অসঙ্গত নয়। এই গ্ৰন্থ পাঠ করে বাংলা দেশের ছেলেমেয়েরা যদি বিমল আনন্দ পায়—সেই সঙ্গে তাদের মনে যদি বিজ্ঞান বিষয়ে গভীর অনুসন্ধিৎসা ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়- তবেই আমার শ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করবো ।
প্রেসিডেন্সি কলেজ পার্থসারথি চক্রবর্তী ২৬ জানুয়ারি, ১৯৯৪
জন্ম : ১৮ই জানুয়ারী ১৯৪১ সন, কৃষ্ণনগর শহরে। লেখাপড়া : কৃষ্ণনগর গভর্মেন্ট কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ণশাস্ত্রের পি-এইচ. ডি.। অধ্যাপনা শুরু করেন ১৯৬৪ সনে প্রথমে মৌলানা আজাদ কলেজে। পরে কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ ও কৃষ্ণনগর গভর্মেন্ট কলেজ। - পার্থসারথি চক্রবর্তী যে খুব বেশীদিন সাহিত্য রচনা করছেন এমন নয়। তবু, এরই মধ্যে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলা কিশোর সাহিত্যের অতি প্রিয় ও অপরিহার্য একটি নাম। বিজ্ঞানের রহস্যকে ছোটদের কাছে গপের মতো মনোগ্রাহী করে তুলতে তাঁর রচনার তুলনা মেলা ভার। তাছাড়া বিষয়বস্তুকে কৌতুহলকর, আকর্ষণীয় ও মজাদার করে তুলতে হয় কোন যাদুতে—তাও তাঁর অজানা নয়। দীর্ঘদিন অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকায় সরস করে বিজ্ঞানের কাজের কথা লিখবার দিকেই তাঁর ঝোঁকটা বেশী। বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞানের উপর ছোটদের জন্য সরস করে লেখা নির্ভরযোগ্য বই এমনিতেই দুর্লভ। পাথসারথি চক্রবর্তী যে শুধু, সেই অভাব পুরণ করে চলেছেন তাই নয়—তাঁর কলমের গুণে সেই লেখা হয়ে ওঠে কখনও ম্যাজিকের মতো, কখনও আজব কাহিনীর মতো অথবা মজার খেলার মতো চিত্তাকর্ষক। ছোটদের মহলে তাই তাঁর বই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। তাঁর লেখা কয়েকটি বিখ্যাত বই : ‘কেমিক্যাল ম্যাজিক’, ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের আজব কথা’, ‘রসায়নের ভেলকি, ‘ম্যাজিকের মতো মজা’, ‘তত সহজ ছিল না। | বৃটিশ গভর্মেন্টের ফেলোসিপ নিয়ে গ্রেট বৃটেন ও ইউরোপের বহু, দেশ ঘুরে এসেছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থা UNICEF-এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা বিভাগে বহু শিক্ষা অধিকর্তার পদে নিযুক্ত আছেন।