‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ রেহমান সোবহান আমাদের দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ। কিন্তু তাঁর পরিচয় কেবল এর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। সেই ১৯৬০-এর দশকের গোড়ায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের উপনিবেশবাদী আচরণ—শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের স্বরূপ যাঁরা উদ্ঘাটন করেছিলেন অকাট্য যুক্তি ও তথ্যসহকারে, তিনি তাঁদের অন্যতম। তাঁদের প্রস্তাবিত ‘দুই অর্থনীতি’র ধারণাই প্রতিফলিত হয়েছিল ছয় দফা দাবিতে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য বইটিতে লেখক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সে অর্থনৈতিক ভিত্তি ও তা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ইতিহাসকেই অত্যন্ত যত্ন ও প্রচুর তথ্যসহযোগে তুলে ধরেছেন। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী লাহোরে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠক, ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়ন, একাত্তরের মার্চে অসহযোগ আন্দোলন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো ও তাঁদের সহযোগীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের শাসনতান্ত্রিক আলোচনা—এসব প্রতিটি পর্বের বর্ণনাও একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে লেখক বস্ত্তনিষ্ঠভাবে এ বইয়ে দিয়েছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলোতে বিদেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত সংগঠনেও অন্য অনেকের সঙ্গে রেহমান সোবহান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সেদিন কত বাধা ও অপপ্রচারের মোকাবিলা করে প্রবাসী বাঙালিদের এই কাজ করতে হয়েছিল, তার কৌতূহলোদ্দীপক বর্ণনাও পাঠক বইটিতে পাবেন।
জন্ম ১৯৩৫ সালের ১২ মার্চ কলকাতায়। তাঁর বাবার নাম কে.এফ.সোবহান। তিনি ছিলেন পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রদূত। তাঁর মায়ের নাম হাসমত আরা বেগম। তিনি দার্জিলিং-এর সেন্ট পলস্ স্কুলে এবং লাহোরের অ্যাচিসন কলেজ থেকে পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়থেকে অর্থনীতিতে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। রেহমান সোবহান ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে দেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন রেহমান সোবহান। অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণের পূর্বে তিনি বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদমর্যাদায়); শিল্প, বিদ্যুত্ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ বিভাগ এবং অবকাঠামো বিভাগে (১৯৭২-৭৪) যথাক্রমে চেয়ারম্যান, গবেষণা পরিচালক, মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বিআইডিএস- এ এমিরিটাস ফেলো হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও কুইন এলিজাবেথ হাউজে ১৯৭৬-১৯৭৯ পর্যন্ত ভিজিটিং ফেলো হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট এর এ্যাডভাইজরী কাউন্সিল (ক্যবিনেট মিনিস্টার এর পদমর্যাদায়), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (১৯৯১) সদস্য ছিলেন। তিনি সাউথ এশিয়া সেন্টার ফর পলিসি ষ্টাডিজ-এ (২০০১-২০০৫) নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। তিনি ১৯৯৪- ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তিনি বিআইডিএসের পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। রেহমান সোবহানের প্রকাশিত মনোগ্রাফের সংখ্যা ৪২ টি। এছাড়া তাঁর বিভিন্ন জার্নালে প্রায় ২০০ এর উপরে লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কাজের প্রধান বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আইয়ুব খানের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচীর রাজনৈতিক সম্পর্ক, মধ্যবর্তী শাসন পদ্ধতিতে সার্বজনীন সাহসী উদ্যোগের ভূমিকা, বৈদেশিক নির্ভরশীলতার সংকট, ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা, কৃষিজ সংস্কার, সমন্বয় নীতি সংস্করণের সমালোচনামূলক নিবন্ধ, দুঃশাসনের ব্যবচ্ছেদ এবং সর্বশেষে দারিদ্র বিমোচনের কৌশল।