রবীন্দ্রনাথের কবি ও গীতিকার সত্তার প্রাধান্যকে মান্য করেও যেমন তাঁর সৃষ্টিশীলতার অন্য সকল প্রান্তের বিপুল উৎকর্ষকে আমরা গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিতে বাধ্য হই, তেমনি তাঁর মননশীলতার বিস্তৃত ও ঋদ্ধ ক্ষেত্রে প্রবেশ করে বিস্ময়ে হই অভিভূত। কত বিচিত্র বিষয় নিয়েই তিনি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সাহিত্য, শিল্প, সৌন্দর্য, শিক্ষা, সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম, বিজ্ঞান- এর প্রতিটি দিকেই ছিল তাঁর বিপুল অভিজ্ঞতা ও গভীর থেকে গভীরতর জ্ঞান। আমাদের এই বাংলার অজ পাড়াগাঁ থেকে শুরু করে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত নগর সর্বত্রই তিনি বিচরণ করেছেন। আবার ভারতের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ গ্রামের অশিক্ষিত কৃষকের চিন্তার পাশাপাশি জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত পাশ্চাত্যের সর্বাধুনিক চেতনার সঙ্গেও ছিল তাঁর নিবিড় পরিচয়। তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে প্রতি ছত্রে ছত্রে ছড়িয়ে আছে বৈশ্বিক পরিমণ্ডল-সম্পর্কিত জ্ঞানের পাশাপাশি গবেষণাধর্মিতা ও রসবোধের নির্যাস। সেই নির্যাসের মধ্য থেকে সেরা-অংশ বাছাই করা নিশ্চিতভাবে দুরূহ। সম্পাদককে সেই কঠিন কাজটি করতে হয়েছে এই সংকলনের প্রবন্ধ নির্বাচন করতে গিয়ে। আশা করি, পাঠক রবীন্দ্র-চিন্তাজগতের সবচেয়ে উন্নত দিকগুলোর সঙ্গে এই সংকলনের মধ্য দিয়ে পরিচিত হতে পারবেন। অনুধাবন করতে পারবেন তাঁর চিন্তনশক্তির ব্যাপ্তি ও উচ্চতা। তাঁর উন্নত সাহিত্যবোধ, সৌন্দর্যজ্ঞান, দেশাত্মবোধ, মানবিকতা ও বিশ্বাত্মবোধের সঙ্গেও পাঠকের নিবিড় পরিচয় ঘটবে এ সংকলন-গ্রন্থের মাধ্যমে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।