বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত “নানা দেশ হতে লোক নবদ্বীপে যায়। নবদ্বীপে পঢ়িলে সে বিদ্যারস পায়।। অতএব পঢ়ুয়ার নাহি সমুচ্চয়। লক্ষ কোটি অধ্যাপক নাহিক নির্ণয়।।” - কবি বৃন্দাবন দাস ভাষা ও জাতি এক নয়। আমরা যখন বাঙ্গালা ভাষার প্রাচীন ইতহাস আলোচনা করি তখন আমাদের এই কথাটি স্পষ্ট মনে রাখা দরকার যে, যে আদিম ভাষা হতে ক্রমশ পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে আধুনিক বাংলা ভাষার উৎপত্তি সেই আদিম ভাষাভাষী জাতি ও বর্তমান বাঙালি জাতি যে এক হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বরং নৃতত্ত্ববিদদের কথা মানতে গেলে আমাদের বলতে হবে যে, জাতিগত পার্থক্যের সত্ত্বেও এক মাতৃভাষা বহু যুগের বহু স্থানের বহু লোকের মুখে মুখে পরিবর্তনের ফলে আমাদের বর্তমান বাংলায় এসেছে। আজ থেকে আনুমানিক প্রায় ৫০০০ বছর আগে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। এতা কম বেশি আমাদের সকলেরই জানা। কিন্তু এই ৫০০০ বছরে ঠিক কত পরিবর্তনের ধারা পার হয়ে আজকের এই বাংলা ভাষা এসেছে তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। এই বইটিতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার আদ্যোপান্ত খুব সুন্দরভাবে এবং সকলের বোধগম্য করে ফুটিয়ে তুলেছেন। নিজের মাতৃভাষার ইতিহাস সম্পর্কে সকলেরই জানা উচিৎ। জরুরী না যে শুধু পাঠ্য হলেই পড়তে হবে। তাই নিজের মাতৃভাষার জন্ম ও পরিবর্তনের ইতিহাস জানতে এই বই সকলেঢ় জন্য অবশ্য পাঠ্য।
Dr. Muhammad Shahidullah ভারতীয় উপমহাদেশের একজন স্মরণীয় বাঙালি ব্যক্তিত্ব, বহুভাষাবিদ, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক ছিলেন। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অবিভক্ত চব্বিশ পরগণা জেলার পেয়ারা গ্রামে ১০ জুলাই ১৮৮৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৪ সালে হাওড়া জেলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স এবং ১৯০৬ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ (বর্তমান এইচএসসি’র সমমান) পাশ করেন। ১৯১০ সালে সিটি কলেজ, কলকাতা থেকে সংস্কৃতে সম্মান-সহ বি.এ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক দর্শনতত্ত্বে এম.এ (১৯১২) ডিগ্রি অর্জন। এছাড়াও, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সরবন বিশ্ববিদ্যালয়, প্যারিস থেকে পি.এইচডি ডিগ্রি (১৯২৫) লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করার পূর্বেই কিছুকাল তিনি যশোর জেলা স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। শহীদুল্লাহ সবসময়ই সাহিত্য কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত ছিলেন। এম.এ পাশ করার পরই তিনি বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির সম্পাদক হন। ১৯৪৮ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন। তিনি উর্দু অভিধান প্রকল্পেরও সম্পাদক ছিলেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক বই লিখেছেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমেরিটাস অধ্যাপক পদ লাভ করেন। একই বছর ফ্রান্স সরকার তাকে সম্মানজনক পদক নাইট অফ দি অর্ডারস অফ আর্টস অ্যান্ড লেটার্স দেয়। ঢাকা সংস্কৃত পরিষদ তাঁকে ‘বিদ্যাবাচস্পতি’ উপাধিতে ভূষিত করে। পাকিস্তান আমলে তাকে ‘প্রাইড অফ পারফরমেন্স পদক’ ও মরণোত্তর হিলাল ই ইমতিয়াজ খেতাব প্রদান করা হয়। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স তাঁকে সম্মানিত সদস্য (ফেলো) রূপে মনোনয়ন করে কিন্তু পাকিস্তান সরকারের অনুমতি না থাকায় তিনি তা গ্রহণ করেন নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে মরণোত্তর ‘ডি লিট’ উপাধি দেয়। ১৯৮০ সালে মরণোত্তর বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের পাশে সমাহিত করা হয়। ভাষাক্ষেত্রে তাঁর অমর অবদানকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ঐ বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ঢাকা হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় শহীদুল্লাহ হল। এছাড়াও তাঁর নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কলা ভবনের নামকরণ করা হয়।