প্রথম অধ্যায়ে, আমি প্রতিভা-দর্শনের দৃষ্টিকোণ সম্বন্ধে সাধারণভাবে আলোচনা করেছি এবং যে দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্র-প্রতিভার ভাস্বর-জ্যোতি নিরীক্ষণ করতে হবে, তার দিকে রবীন্দ্রসাহিত্য-রসিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। বলা বাহুল্য, এই অধ্যায়ের আলোচনা দর্শন ঘেঁষা না হয়ে পারেনি। , দ্বিতীয় অধ্যায়েআমি রবীন্দ্র-যুগের স্বরূপটি উপস্থাপিত করতে চেষ্টা করেছি এবং সমাজবিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষত বাঙালীজাতির ক্রমবিকাশের পটভূমিকাতে দাঁড় করিয়ে রবীন্দ্র-যুগটির বিশেষ বিশেষ প্রবণতা নির্দ্ধারণ করতে চেষ্টা করেছি। জাতীয় জীবনের রাজ-আর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্রিয়া-কলাপের পরিপাটি পরিচয় দিতে হলে যতখানি অবকাশ আবশ্যক, ততখানি অবকাশ এখানে পাওয়া, সম্ভব নয় বলেই, তালিকা দ্বারাই অনেকক্ষেত্রে বক্তব্যকে সংকেতিত করতে হয়েছে। তার ফলে অধ্যায়টি বেশ একটু তালিকা-ভারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এর পর যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে সমালোচনা করতে এগিয়ে আসবেন, আশা করি, এই অধ্যায়টি তাঁদের কিছুটা সাহায্য করতে পারবে। তৃতীয় অধ্যায়ে, আমি রবীন্দ্র-মানসের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছি। তাঁর পরাদর্শন, দেবতাদর্শন, ধর্মদর্শন, নীতিদর্শন, সমাজদর্শন, সৌন্দর্য্যদর্শন, শিল্পদর্শন-সমস্ত রকমের দার্শনিক সংস্কারের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেষ্টা করেছি এবং এই উদ্দেশ্য নিয়েই করেছি যে, রবীন্দ্রনাথের জ্ঞান-অনুভব-ইচ্ছার বৈশিষ্ট্যটুকু ধরতে পারলে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির স্বরূপ ও উদ্দেশ্য বুঝতে বেগ পেতে হবে না। এই অধ্যায়ে আমি নিজে খুবই কম কথা বলেছি এবং রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই অধিকাংশ কথা বলিয়েছি—বলা যেতে পারে— গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা করেছি। বলাবাহুল্য, 'রবীন্দ্রমানস' বড় একখানা গ্রন্থের পরিসরে আলোচনার যোগ্য বিষয়; একটি অধ্যায়ের পরিসরে তাকে পরিপাটি করে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে, আমি রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিতে পরিবেশ-সাপেক্ষতা কিভাবে এবং কতখানি ধরা পড়েছে তার আলোচনা করেছি। আমি রবীন্দ্রনাথের মুক্তিচিন্তার বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। ষষ্ঠ অধ্যায়ে, আমি রবীন্দ্র-রচনার একটি তালিকা দিয়েছি, এই তালিকা দেওয়ার উদ্দেশ্য রবীন্দ্রনাথকে একনজরে দেখানো। এই অধ্যায় রচনায় আমি দুই জন মনীষীর কাছে সর্বতোভাবে ঋণী; এঁদের একজন হলেন ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যজন রবীন্দ্রজীবনীর স্বনামধন্য লেখক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। তালিকাটি সর্বতোভাবে নির্ভুল— এ দাবি করতে পারলে সুখীই হতাম ; কিন্তু সে দাবি করবার সাহস পাচ্ছিনা। আশা করি সহৃদয় পাঠক ক্ষমাদৃষ্টিতে এই দোষটুকু দেখবেন। সপ্তম অধ্যায়ে , আমি রবীন্দ্রনাটকের ধারাটি পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। সংক্ষিপ্ত আলোচনার সাহায্যে রবীন্দ্রনাথের নাটকসমূহের ভিতরকার কথা ব্যক্ত" করতে চেষ্টা করেছি। জানিনা এই চেষ্টা কতদূর সফল হয়েছে। তবে এটুকু বলতে পারি যে নাটক-সম্পর্কিত কোনো সমস্যাকেই আমি এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করিনি। পরিশেষে, আমি বাংলা নাট্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ দান, রবীন্দ্রনাট্যের রীতি এবং রবীন্দ্রনাট্য প্রযোজনা প্রসঙ্গে অতিসংক্ষেপে দু’একটা কথা বলেছি। অবশ্যই এই বিষয় পৃথক পৃথক অধ্যায় দাবি করতে পারে। এই দাবী পূরণ করতে আমি পারিনি, তেমন চেষ্টাও করিনি। প্রথম কারণ রূপকধর্মী ও সংকেতধর্মী রচনার বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রত্যেক রবীন্দ্রনাট্য-সমালোচকই যথাসাধ্য আলোচনা করেছেন, এবং দ্বিতীয় এবং প্রধান কারণ- গ্রন্থের কলেবর আরো অধ্যায় যোজনার ব্যাপারে অসহিষ্ণু।