প্রেমের কবিতা বিষ্ণু দে-র কবিতার অনেকখানি জায়গা জুড়ে রয়েছে। তার বেশ কিছু একত্রে পরপর পড়তে পেয়ে তাঁর কবিতার পাঠক আনন্দিত হবেন, অল্প-পরিচিত বা একেবারে অপরিচিত পাঠক ও উপকৃত হবেন – এই মনে করে বইটির প্রকাশনা । এবার সম্পাদনার কথায় আসি। এ-বইয়ের বেশ কিছু কবিতা কোনো দীর্ঘ বা দীর্ঘতর কবিতার অংশ মাত্র। স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতা হিসাবেই তারা এখানে তাদের জায়গা করে নিল। মূল কবিতার দিক থেকে দেখলে হয়ত এভাবে অংশ তুলে দেওয়া ঠিক নয়, কিন্তু মূল কবিতাই এখানে অনেকটা পিছনে সরে গিয়েছে। সেই কারণে তার নাম-কবিতাটির পরিচয় দেওয়ার জন্য দরকার হলেও— যেমন দরকার যে বইয়ের থেকে কবিতা তার নাম- নাম হিসাবে ঠিক সঙ্গত নয়। অনেকটা গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মতো যে অংশটুকু নিয়েছি তার প্রথম ক'টি শব্দ বা পুরো লাইন উদ্ধৃতি-চিহ্নের মধ্যে রেখে নতুন করে কবিতার শিরোনাম দিলাম ৷ মূল কবিতার নাম পরে বন্ধনীর মধ্যে ও বইয়ের নাম কবিতার শেষে দেওয়া আছে। ঠিক দীর্ঘকবিতা নয়, বরং একটিই শিরোনামে লেখা কবিতাগুচ্ছ বা কবিতা- মালা থেকে নেওয়া কবিতারও এই একইভাবে শিরোনাম দিলাম । যেখানে কবি সঙ্কলিত কবিতাগুলির আলাদা নাম দিয়েছিলেন সেখানে আর এই শিরোনাম - রীতির প্রয়োজন হয়নি । সেখানে কোলন-চিহ্নের ব্যবধানে কবিতাগুচ্ছের নাম ও কবিতাটির নাম, দুই-ই রইল । কবিতা সাজানো সম্পর্কে কিছু বলার আছে। ‘পরপর পড়া'র কথা প্রথমেই বলেছি। মনে হতে পারে রচনাকাল অনুসারে কবিতা সাজানো হয়েছে। কিছুটা তাই, পুরোপুরি নয়—সম্ভবও নয়। বহু কবিতার সঠিক রচনাকাল, বলা যায়, ‘অনুমানে শুরু, সমাধা অনিশ্চয়ে'। সেদিকে আর বেশীদূর না গিয়ে মোটামুটি একটা রচনাকালের হিসাবের সঙ্গে শুধুই কবিতাপড়ার তৃপ্তির কথা – যেমন একই সুরের, বা ভাবের সংক্রমণের, কবিতা পরপর পড়ার তৃপ্তি, আমাদের যা ঠেকেছে— মনে রেখে কবিতা সাজালাম। সেইজন্য কোনো কোনো জায়গায় রচনাকাল-জানা কবিতাও কিছু আগে-পরে করে রেখেছি। এই জটিল বিষয়টিতে বা তার তথ্যে বইটিকে আর অযথা ভারাক্রান্ত করছি না। ...
বিষ্ণু দে (১৮ জুলাই ১৯০৯ - ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২) একজন বিখ্যাত বাঙালি কবি লেখক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক। তিনি ১৯৭১ সালে তাঁর স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ বইটির জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জ্ঞানপীঠ লাভ করেন। বিষ্ণু দের পিতা অবিনাশ চন্দ্র দে ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। বিষ্ণু দে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট এবং সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল-এ পড়াশোনা করেন । ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর বঙ্গবাসী কলেজে আইএ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে সাম্মানিক ইংরাজি বিষয়ে স্নাতক হন সেন্ট পল্স কলেজ থেকে। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম এ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি রিপন কলেজে (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) যোগদান করেন শিক্ষক হিসেবে। এরপর তিনি ১৯৪৪ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্সি কলেজে এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি মৌলানা আজাদ কলেজে পড়ান। এরপর তিনি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজেও অধ্যাপনার কাজ করেছেন। ১৯২৩ সালে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে যে সাহিত্য আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল কবি বিষ্ণু দে তার একজন দিশারী। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতায় তার অবদান বাংলা সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে। ১৯৩০ সালে কল্লোলের প্রকাশনা বন্ধ হলে তিনি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় পত্রিকায় যোগদান করেন এবং সেখানে একজন সম্পাদক হিসাবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ১৯৪৮ সালে চঞ্চল কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সহায়তায় তিনি সাহিত্য পত্র প্রকাশ করেন। তিনি নিরুক্তা নামের একটি পত্রিকাও সম্পাদনা করেছিলেন। তার কবিতার মূল উপজীব্য হল মানুষ, তার সংগ্রাম ও রাজনীতি, সেখানে সমকালীন জীবনের, দেশ ও কালের, রাজনীতি ও সমাজের প্রতিধ্বনি। প্রথমদিকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের দুই সংস্কৃতিরই প্রভাব পড়েছে তার লেখায়। দেশীয় পুরাণ, ইতিহাস, দর্শন, শিল্পসাহিত্য থেকে ইউরোপীয় ক্লাসিক ও আধুনিক শিল্প সাহিত্যের প্রভাব এবং পরে দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানের সময়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, তেভাগা-আন্দোলন ইত্যাদি থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পরের ঘটনাবহুল জীবন ও আন্দোলন তাঁর কবিতায় সরাসরি ছায়া ফেলেছে। তিনি বামপন্থী দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এছাড়া কবি টি এস এলিয়টের রচনাশৈলী এবং ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি ছড়ানো এই জীবন নামে একটি আত্মজীবনী লিখেছিলেন। এছাড়াও অনুবাদের কাজ করেছেন। তার অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে আছে এলিয়ট, পল অ্যালুয়ার ও মাও-ৎ-সেতুঙের কবিতা। বিষ্ণু দে'র সঙ্গে শিল্পকলা বিশেষজ্ঞ শাহেদ সোহরাওয়ার্দী ও শিল্পী যামিনী রায়ের বন্ধুত্ব ছিল। তিনি অঙ্কন শিল্পের উপর কিছু বই রচনা করেন, যেমন আর্ট অফ যামিনী রয়(সহযোগে) দ্য পেন্টিংস অফ রবীন্দ্রনাথ টেগোর (১৯৫৮) এবং ইন্ডিয়া অ্যান্ড মডার্ন আর্ট (১৯৫৯)। তিনি ক্যালকাটা গ্রুপ সেন্টার, সোভিয়েত ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন, প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ, ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েসন, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ প্রভৃতি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ছবিও আঁকতেন। সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, নেহরু স্মৃতি পুরস্কার, এবং জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেছিলেন। এছাড়া তিনি সোভিয়েত ল্যান্ড অ্যাওয়ার্ড পান।