আমিও একথা জানি যে কবিতার ঠিক-ঠিক অনুবাদ হয় না কিছুতেই, তবু করতেও চাই অনুবাদ, ভালোলাগার টানে। এসব লেখাকে অনুবাদ না বলে অনুসর্জন বলাই কি তাই সংগত? কেননা সৃজনের আনন্দও যদি কিছুটা না লেগে থাকে এর গায়ে, তবে কেনই-বা এত আয়োজন! সৃজন কথাটার মানে অবশ্য এ নয় যে তার নেশায় ইচ্ছেমতো সরে যাব দূরে, তৈরি করে তুলব একেবারেই নিজের মতো ছন্দ-শব্দ-ছবি নিয়ে খেলা, রবার্ট লোয়েল যেমন ভেবেছিলেন তাঁর ইমিটেশন্স্’ নামের বইতে। অনুবাদের প্রসঙ্গে ভালেরি বলেছিলেন একটা ‘approximation of form'-এর কথা। অনুবাদ্য কবিতার মূল নিশ্বাসের কাছে পৌঁছবার জন্য অনুবাদের ছন্দে শব্দে আনতে হয় তেমনি একটা তুল্য-রীতি মাত্র, একটা approximation, সৃষ্টির স্বাধীনতা নেওয়া যায় সেই পর্যন্ত শুধু। আমি অন্তত আমার বোধবুদ্ধিমতো অনুগতই থাকতে চেয়েছি মূল লেখাগুলির কাছে, ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষার ক্ষেত্রে অন্যের সাহায্য নিয়ে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এও সত্যি যে, অনুবাদের সময়ে মনে রাখতে চেয়েছি আমার ভাষার পাঠকদের কথা, লক্ষ্যে রাখতে চেয়েছি তাঁদের অভিজ্ঞতা আর প্রত্যাশার পরিধি। কবিতাগুলি যদি বাংলায় কিছুমাত্র কবিতার মতো না শোনায়, তদ্গত হবার আপ্রাণ চেষ্টায় যদি আড়ষ্টতাই শুধু থেকে যায় লেখায়, তাহলে অনুবাদ করবার আর মানে থাকে না বড়ো। নিজের ভাষার কবিতা হিসেবে পাঠযোগ্য আর স্ফুরণময় হয়ে ওঠাতেই অনুবাদ-কবিতার প্রধান সার্থকতা, আর সেই কাজে এটা হতেই পারে যে মূল কবির সঙ্গে এখানে মিশে থাকে অনুবাদকেরও সত্তা। এই অর্থে, কবিতার বিশুদ্ধ তদ্গত অনুবাদ শেষপর্যন্ত কোথাও পাওয়া যাবে বলে বিশ্বাস হয় না। তিরিশ বছর জুড়ে যত অনুবাদ করেছি, এ তার সমগ্র কোনো সংকলন নয়, তার ছোটো-একটি নির্বাচন মাত্র। ইচ্ছে করেই এখানে বর্জন করেছি অনেক লেখা, হারিয়েও গেছে অনেক, অতর্কিতেও বাদ চলে গেছে কিছু। ছাপার কাজ শেষ হবার মুখে যেমন মনে পড়ল কয়েকটি সাঁওতালি ছড়ার কথা, কিন্তু তখন আর তাকে জুড়ে দেবার উপায় নেই। এই জন্য উপায় নেই যে বইটির লেখাগুলির মধ্যে প্রচ্ছন্ন একটা বিন্যাস আছে, যে কোনো জায়গায় তাকে ভাঙা মুশকিল। সে-বিন্যাসে কালক্রম বা দেশক্রমের কথা বিশেষ ভাবা হয়নি, কবিতাগুলির প্রধান পরম্পরা সেখানে নয়, এর পরম্পরা আছে বাচনের দিকে, অন্তত সেইরকমই ভাবতে চেয়েছিলাম আমি। ‘ভারবি’ থেকে ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা' যখন প্রথম ছাপা হয় ১৯৭০ সালে, তার একটি অংশের শিরোনাম ছিল ‘শিকড়ের ডানা', সেইখানে ছিল কয়েকটি অনুবাদকবিতা। পরের সংস্করণগুলিতে সে-অংশ রাখিনি আর, কিন্তু নামায়নের সেই মুহূর্ত থেকেই কল্পনা ছিল এক অনুবাদসংগ্রহের, যার নাম হবে ‘শিকড়ের ডানা’, অনুবাদের মূল আবেগটাকে প্রকাশ করতে পারবে যে নাম, যে-নামের ইশারা পেয়েছিলাম হিমেনেথের কবিতায়। কিন্তু কিছুকাল আগে বন্ধু দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, আমাকে জানিয়েই, তাঁর চমৎকার হিমেনেথ-অনুবাদটি ওই নামে প্রকাশ করেছেন বলে নতুন একটি নাম ভাবতে হলো আবার। এবার আর হিমেনেথ নয়, ‘দি ড্রাই স্যালোয়েজেস’ থেকে উঠে এল বইয়ের পরিচয়। এলিয়টের ওই কবিতাটিতে সমুদ্রের ছিল বহু স্বর : Many gods and many voices! দেশদেশান্তরের যুগযুগান্তরের কবিদের স্বরই তো আমাদের কাছে কখনো কখনো হয়ে ওঠে সেই সমুদ্র, সেই মহাসময় ! ইচ্ছে ছিল, খুব ছোটো হলেও, তারই একটা আভাস ধরা থাকবে এই অনুবাদগুলিতে, বহু কবির এই বহুল কবিতায়।
জন্ম ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২। তিনি একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কবি ও সাহিত্য সমালোচক। তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। তাঁর প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। যাদবপুর, দিল্লি ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপনাও করেছেন। বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ খ্রিঃ লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান ,জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলি হল মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, এ আমির আবরণ, উর্বশীর হাসি, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি। শঙ্খ ঘোষ ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় কলা বিভাগে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে অবসর নেন। ১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে আইওয়া রাইটার্স ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। তিনি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়,শিমলাতে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ আডভান্স স্টাডিজ এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অনেকগুলো অনেকগুলো পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।