ভারতবর্ষে জরুরী অবস্থা চলাকালীন এই লেখা ধারাবাহিকভাবে অমৃত সাপ্তাহিক পত্রিকাতে যখন লিখি তখন এই রকমই ইচ্ছা ছিল যে, আমাদের দেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের নানা দিকের তুলনামূলক আলোচনাসমেত একটি হালকা সুখপাঠ্য ভ্রমণ উপন্যাস লিখব। কিন্তু তুলনা করতে গিয়েই বিপত্তি বাধল। প্যারাগ্রাফের পর প্যারাগ্রাফ সেন্সরড্ হতে লাগল এবং তার বদলে ছবি, স্কেচ ও ফটোগ্রাফ ছাপা হতে লাগল লেখার মধ্যে মধ্যে। এরকম অপমানকর অবস্থায় লেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না বলে যখন লেখা মাঝপথে বন্ধ করে দিলাম প্রায় বিদ্রোহ করেই; তখন সম্পাদক বিজ্ঞাপন দিলেন যে, লেখকের অসুস্থতার কারণে লেখা আর সম্ভব হচ্ছে না। সুস্থ অবস্থায় অনেকানেক আরোগ্য-কামনা এল চিঠি ও ফোন মারফৎ। ভালোই লেগেছিল। অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী সম্পাদক খুবই হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন আমার; স্নেহও করতেন খুব। তিনি বললেন, যা হল ভালোই হল, নইলে বিলক্ষণ বিপদে পড়তেন। কিন্তু বিপদে পড়লামই। অতর্কিতে একদিন সন্ধ্যেবেলায় পশ্চিমবঙ্গ পুলিসের স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের দু-গাড়ি অফিসার এসে আমার সম্ভাব্য ও অসম্ভাব্য সব বাসস্থানে একসঙ্গে তল্লাসী চালালেন। অবশ্য, অত্যন্ত ভদ্রভাবেই। আমি যে বাড়িতে ছিলাম না, সেটা তাদের এবং আমার দু-পক্ষেরই মঙ্গলের কারণ হয়েছিল। আমি বাড়ি থাকলে কী কাণ্ড ঘটত ঠিক বলা যায় না। যে কারণ, আমার আত্মীয়দের কাছে মৌখিকভাবে ব্যক্ত করেছিলেন ওঁরা, সেটা, এদেশীয় পুলিসী ট্রাডিশানুসারেই; সর্বৈব মিথ্যা। মিথ্যা বলে, আমি তো জানিই; ওঁরাও হয়তো জানতেন। সে কারণেই, এ বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, মূল 'প্রথম প্রবাসে' আমাদের দেশীয় রাজনীতিকদের যে সমালোচনা করেছিলাম, সেই সমালোচনার জন্যেই এই হয়রানি। এই কারণহীন ও অপমানকর হয়রানির জন্যে কোনো কমিশানের কাছে নালিশ করে নায়ক হওয়ার অভিপ্রায় আমার ছিল না এবং নেইও। নালিশ এই প্রথমবারই জানালাম পাঠক- পাঠিকাদের কাছে। তাঁদের চেয়ে বড় হিতাকাঙ্ক্ষী ও অভিভাবক লেখকের আর কে আছেন? আমি ইংরিজী ছাড়া বিদেশী অন্য কোনো ভাষা জানি না। তাই বিভিন্ন বিদেশী ভাষার নাম ও জায়গা বিশেষের উচ্চারণে এবং হয়তো বানানেও কিছু কিছু ভুল থাকা অসম্ভব নয়। এই লেখা পাঠকদের মনোমত যদি হয়, তাহলে পরে, কানাডা, ইউ.এস.এ., হাওয়াই, আফ্রিকা এবং জাপানের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখার ইচ্ছা রইল। তবে, কবে যে হয়ে উঠবে তা বলা মুশকিল। পাঠক-পাঠিকাদের মতামত, এই বই সম্বন্ধে জানতে পেলে খুশি হব।
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।