তীর্থের ডাক কেন আমাকে এমন আকুল করে? তীর্থের দেবতাদের কাছে আমার তো কোনো কামনা নেই। আমি পুণ্য সঞ্চয়ের প্রত্যাশী নই। আমার স্বর্গের মোহ নেই, নরকের ভয় নেই। তাহলে আমি কেন তীর্থের নামে এমন উতলা হয়ে উঠি? আমি যে ভারতবাসী। তীর্থের আকর্ষণ রয়েছে রক্তে। এদেশে এ আকর্ষণ কোনো বিশেষ বয়সের নয়, সারা জীবনের। ভারতের ধনী-দরিদ্র, পণ্ডিত-মূর্খ, ব্রাহ্মণ-শূদ্র—সবাইকে তীর্থের ডাক এমনি আকুল করে তোলে। আমি খঞ্জকে অমরনাথ গুহায় চোখের জল ফেলতে দেখেছি, অন্ধকে কাশী বিশ্বনাথের মাথায় জল ঢালতে দেখেছি। তীর্থের ডাকে আমার উতলা হয়ে ওঠার আরও একটি কারণ আছে। আমি শুধু তীর্থ-দর্শনে আসি না, তীর্থযাত্রীদেরও দেখতে আসি। এই মানুষগুলোর কোনো আলাদা জাত নেই, এঁরা শুধুই তীর্থযাত্রী। এঁরা শিক্ষা-দীক্ষা কিংবা অবস্থার মুখাপেক্ষী নন। ভাষা পোশাক ও চেহারা ভিন্ন হলেও এঁদের উদ্দেশ্য অভিন্ন। এঁরা দুঃসহ-কষ্ট সয়ে একই উদ্দেশ্যে পাশাপাশি পথ চলেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে তীর্থের পথে পথে আমি এই একই মানুষকে পদচারণা করতে দেখি । এই মানুষগুলোকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। তাই বার বার এমন উতলা হয়ে ছুটে আসি তীর্থের পথে—এক তীর্থের পরে আরেক তীর্থে। আমি যে ভাগ্যবান, আমি ভারতবাসী। ভারতে তীর্থের শেষ নেই।
Shonku Moharaj বর্তমান বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্যের জনপ্রিয়তম নাম। সুগত সাতাশ বছরে তাঁর ছত্রিশটি শিল্পকর্মের মধ্যে তিনখানি বাদে বাকি সবকটিই ভ্রমণকাহিনী। তাঁর পনেরোটি হিমালয়-কাহিনীর শেষখানি ব্রহ্মলোকে। বিগত গ্রন্থে শঙ্কু মহারাজ-এর সারথ্যে পাঠক-পাঠিকার মানস-ভ্রমণ সম্পণ ‘হয়েছে সূদূরবতী’ সুইজারল্যান্ডে, জয়ন্তী জুরিখে। য়ুরোপের আলপস থেকে স্বল্প স্বাদবদল করে লেখক আবার ফিরে এলেন হিমালয়ে, দেশমাতার পূজায় পুনরায় নিজেকে নিবেদন করতে। বিচ্ছেদবাদ যখন ভারতের অঙ্গচ্ছেদনে শামিল, জাতীয় চেতনার সামনে তখুনি তিনি তুলে ধরলেন গুর্জর কিশোরী শ্যামা আর কিশতোয়ারী মালবাহক আবদুল রসিদের কথা, যারা বিদায়বেলায় বাঙালি অভিযাত্রীদের জন্য চোখের জল ফেলে, হিন্দু সাহেবদের নিরাপত্তার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কারফিউ কবলিত শহরে ছুটে আসে। বাঙালির কাছে প্রায় অপরিচিত কিশতোয়ার-হিমালয়ের ওপরে রচিত বাংলাসাহিত্যের প্রথম ভ্রমণকাহিনী এই ব্রহ্মলোকে। কলকাতার একদল দামাল যুবক গিয়েছিলেন কিশতোয়ার হিমালয়ের দুগেমতম শৃঙ্গ ব্রহ্মা-১ (২১,০৪৯) পর্বতাভিযানে। লেখক সেই অভিযাত্রীদের অন্যতম। তবে তিনি কেবল পর্বতারোহণ নিয়েই ব্যস্ত থাকেননি। সেই সঙ্গে তাঁর সাবলীল ভাষায় বলেছেন, অনাবিষ্কৃত বিশতোয়ার হিমালয়ের ভাষা ভূগোল ইতিহাস গাছপালা পশু-পাখি পাহাড় ও পথের কথা, বলেছেন সরল ও সুন্দর মানুষদের কথা, যাঁদের সহজ জীবন আর লেখকের সরস লিখন একযোগে পাঠক-পাঠিকাকে নিয়ে যাবে ব্রহ্মলোকের ব্রজ্যায়।