“হাজার চুরাশির মা” বইয়ের ভূমিকাঃ মহাশ্বেতা দেবী। তিনি উপন্যাসিক। তিনি লেখেন গণতান্ত্রিক জটিলতা নিয়ে। তিনি প্রশ্ন তোলেন প্রতিটি বিবেকবান মানুষের প্রতি, জিজ্ঞাসা করেন পাঠককে, গণতন্ত্রের পাঠককে গণতন্ত্রের পথিককে, রাষ্ট্রযন্ত্রের জটিলতা নিয়ে। নগরউন্নয়ণের পশ্চাতে যে সু-গভীর অন্ধকার খাদ তৈরি হচ্ছে তিনি সেখানে আলো ফেলেন। তিনি তখন মহাশ্বেতা নন কখনো তিনি দেবী ও মাতা- যখন কলমের মতো অস্ত্র নিয়ে প্রতিরক্ষার যুদ্ধে নেমে পড়েন বঞ্চিতদের পক্ষে; ক্ষুদ্র ণৃ-গোষ্ঠীর মানুষের পক্ষে। মহাশ্বেতা আদিবাসীদের কাছে দেবী ও মা। তিনি সুবিধা ও প্রাপ্য বঞ্চিত সকল মানুষের লেখক। তিনি মার্ক্সীয় ধারার সাহিত্য রচনার প্রতি বিশেষ মনোযোগী। সমাজের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই তার গল্পের উপস্থাপনা ও শরীর নির্মাণ। তিনি ফিরে যান উৎসের কাছে, কৃষির কাছে, আদিবাসীদের কাছে আর তা না হলে যেন তিনি জীবন ফিরে পান না। প্রকৃতি বিজ্ঞান তাকে কেন্দ্রের দিকে টানে, গভীরভাবে টানে। তিনি যেন মার্কসের এই কথাগুলোই বলেন- ‘...আর সত্য সত্যই প্রতি দিনে-দিনে আমরা এই নিয়মগুলোকে আরও নির্ভুলভাবে জানতে শিখি, প্রকৃতির চিরাচরিত গতিধারার মধ্যে হস্তক্ষেপের অপেক্ষাকৃত আশু বা অপেক্ষাকৃত সুদূর ফলাফল কী হবে তা আমরা বুঝতে পারি...। ...আর যতই তা ঘটতে থাকবে ততই প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা মানুষ শুধু অনুভব নয়, উপলব্ধিও করবে, ততই অসম্ভব হয়ে উঠবে মানুষ আর বস্তু, মানুষ আর প্রকৃতি, দেহ আর আত্মার মধ্যে বিরোধের অর্থহীন অস্বাভাবিক সেই ধারণা...'। হাজার চুরাশির মা' উপন্যাসটি একটি লাশের গল্পকে কেন্দ্র করে নির্মিত। একজন সৎ, বিবেকবান বিপ্লবী সন্তানের মৃতদেহের পরিচয় দিতে অবশেষে কেউ আর রইল না। পরিবারে অন্যান্য-সদস্য থেকে এমনকী কোনও আত্মীয়-স্বজনও নয়। তিনি মা। তিনিই হাজার চুরাশি নম্বর লাশটির মা হয়েই মর্গের দরজায় অপেক্ষা...। উপন্যাসটির শরীরের এক প্রান্তের সংলাপ এমনই— ... মিঃ কাপাডিয়া নিখুঁত বাংলায় বলতে লাগলেন, দেশের সমস্যা কি বলুন? ইনটিগ্রেশন হচ্ছে না। বহু ধর্ম, জাতি, ভাষা হবার দরুণ দেশটা ভেঙে যাচ্ছে। ফুড কোনও সমস্যাই নয়। ফুডয়েটে হচ্ছে কি? চাষীরা অত্যন্ত ওয়েল অফ। সবাই রেডিও কিনছে।... “বিশ্বদেব চৌধুরী”
১৪ জানুয়ারি, ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা শহরে মহাশ্বেতা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক ও মানবাধিকার আন্দোলনকর্মী।তাঁর বাবা মণীষ ঘটক ছিলেন কল্লোল সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মনামে লিখতেন। মণীষ ঘটকের ভাই ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। মহাশ্বেতা দেবীর মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন লেখক ও সমাজকর্মী। তাঁর ভাইয়েরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ছিলেন। যেমন, শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর এবং শচীন চৌধুরী ছিলেন দি ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মহাশ্বেতা দেবীর বিদ্যালয়-শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঢাকা শহরেই। ভারত বিভাজনের পর তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠভবনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলি হল হাজার চুরাশির মা, রুদালি, মার্ডারারের মা, বেহুলার বারোমাস্যা, দিয়া ও মেয়ে নামতা, স্বপ্ন দেখার অধিকার, প্রস্থানপর্ব, ব্যাধখণ্ড, অরণ্যের অধিকার ইত্যাদি। মহাশ্বেতা দেবী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তীসগঢ় রাজ্যের আদিবাসী উপজাতিগুলির (বিশেষত লোধা ও শবর উপজাতি) অধিকার ও ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করেছিলেন। তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (বাংলায়), জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার সহ একাধিক সাহিত্য পুরস্কার এবং ভারতের চতুর্থ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান যথাক্রমে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ লাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেছিল। তিনি ২৮ জুলাই, ২০১৬ মৃত্যুবরণ করেন।