মুখে যারা খুব সাহস দেখিয়ে বলে ভূত-টুত বলে কিছু নেই, তেমন তেমন অবস্থায় পড়লে তাদেরও কিন্তু পিলে চমকে ওঠে ভূতের ভয়ে। ধরা যাক বাড়িসুদ্ধ সবাই গিয়েছেন নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে, একা বাড়িতে বুক একটু ঢিপ ঢিপ করছেই, তার ওপর হঠাৎ হয়ে গেল লোডশেডিং। কিংবা ধরা যাক শেষ গাড়িতে বাড়ি ফিরতে হল বাধ্য হয়ে, রাস্তায় একটি লোক নেই, জন নেই, এমন সময় পেছনে পায়ের শব্দ। ঘুটঘুটে রাত, ঝমঝমে বৃষ্টি কিংবা জমাটি ভূতের গল্পের আসরেও বুক ফুলিয়ে বলতে পারে ভূত-টুত মানি না, এমন ডানপিটে ছেলে খুঁজে পাওয়া শক্ত। মানি আর নাই মানি, ভূতের গল্প পড়তে যে সকলেরই ভালো লাগে এ কথা অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই। ভূতের গল্প যাঁরা জমিয়ে লিখেছেন, তাঁরা এমন গা শিরশির-করা একটা পরিবেশ তৈরি করেন যে অতি বড় সাহসীরও কেমন গা ছমছম করে। তা করে বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে ভূতের গল্প পড়বার একটা মজাও আছে, যদি সেরকম করে জমিয়ে কেউ বলতে পারেন। আমরা আমাদের এই সংকলনে তাই আশি জন এমন সেরা ভূতের গল্প-লিখিয়েকে জড়ো করেছি যাঁদের লেখা পড়তে পড়তে বড়-ছোট সব বয়সের মানুষেরই রক্ত হিম হয়ে যায়। এঁদের মধ্যে যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সেকালের দিকপাল সাহিত্যিক আছেন, তেমনি আছেন এখনকার দিনের সাহিত্যিক যাঁদের বয়স হয়তো কম কিন্তু লেখার ক্ষমতা একটুও কম নয়। কাজেই দেরি করে লাভ নেই, এরকম বই হাতে পেলে দেরি অবশ্য করাও যায় না। একের পর এক গল্প পড়তে শুরু করলে আর থামা যায় না—আর শেষ হলে মনে হয়, ইস এত বড় বই কিনা এত চট করে ফুরিয়ে গেল!
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের টালমাটাল সময়ে পরিবারসমেত কলকাতা পাড়ি জমান। বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শৈশব কেটেছে তার। কোচবিহার বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। মাধ্যমিক পাস করেন কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। পরে কলকাতা কলেজ থেকে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শীর্ষেন্দু তার পেশাজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন কিছুদিন। বর্তমানে সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বইপড়ুয়া ছিলেন। হাতের কাছে যা পেতেন তা-ই পড়তেন। খুব ছোটবেলাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় এর মতো লেখকদের রচনাবলী পড়ে শেষ করেছেন। এই পড়ার অভ্যাসই তার লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৭ বছর পর দেশ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। এরপর থেকেই নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই এর সংখ্যা দু’শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পার্থিব, দূরবীন, মানবজমিন, গয়নার বাক্স, যাও পাখি, পারাপার ইত্যাদি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর রহস্য সমগ্র রহস্যপ্রেমীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রায় ৪০ এর অধিক রহস্য গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘অদ্ভুতুরে সিরিজ’ নামকরণে। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, ভুতুড়ে ঘড়ি, হেতমগড়ের গুপ্তধন, নন্দীবাড়ির শাঁখ, ছায়াময় ইত্যাদি এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমূহ দুই বাংলায় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে সমানতালে। এছাড়াও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমগ্র অবলম্বনে বিভিন্ন সময় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার উপন্যাস ‘যাও পাখি’ এবং ‘মানবজমিন’ নিয়ে বাংলাদেশেও ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে। তার সৃষ্ট চরিত্র শাবর দাশগুপ্ত এবং ধ্রুব পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র জন্য ১৯৮৫ সালে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ পান। ১৯৭৩ এবং ১৯৯০ সালে পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার'। ১৯৮৮ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য অর্জন করেন ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’। এছাড়াও, ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ লাভ করেন তিনি।