'অপরাজিত' বইয়ের ফ্লাপের লেখা অপরাজিত’ বিভূতিভূষণের দ্বিতীয় উপন্যাস। এটি ‘পথের পাঁচালী'র অপু-কাহিনিরই সম্প্রসারিত রূপ। নিশ্চিন্দিপুরের অপুকে এই উপন্যাসে লেখক স্থাপন করেছেন এক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে। পিতার মৃত্যু, মায়ের উচ্চাশাহীন গণ্ডীবদ্ধ জীবনের বন্ধন কেটে কলেজে ভর্তি হওয়া, কলেজ জীবনের নিদারুণ দারিদ্রের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম, মায়ের মৃত্যু, হঠাৎ বিবাহ, স্ত্রী অপর্ণার সাহচর্যে একটা অল্পস্থায়ী শান্তির নীড়রচনার প্রয়াস এবং অপর্ণার আকস্মিক মৃত্যুতে সে প্রয়াসের সমাধি। নিঃসঙ্গ শূন্যতার আক্রমণে এমনকি সদ্যোজাত পুত্র-কাজল সম্পর্কে অনীহা। চাদপানিতে উদ্দেশ্যহীন, ইতর-সংসর্গে অতিবাহিত জীবনযাত্রা। চাদপানি থেকে দিল্লির পূর্বগৌরবের স্মৃতিসমাকুল। ভগ্নাবশেষ ও মধ্যপ্রদেশের আরণ্য বিজনতা। প্রকৃতির অবাধ বিজনতায় এই নবদীক্ষার পর অপুর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। বাল্যবান্ধবী অসুখী দাম্পত্যজীবনের শিকার লীলার সঙ্গে মধুর। সম্বন্ধ-সমবেদনার মধ্য দিয়ে প্রেমের কাছাকাছি পৌছনাের মুহূর্তে লীলার অতর্কিত আত্মহত্যায় এই ফুটমান প্রেমের অকাল পরিসমাপ্তি। অপুর কাশীযাত্রা। সেখানে নিশ্চিন্দিপুরের বাল্য সহচরী রানুদির সঙ্গে সাক্ষাৎ | মাতৃহারা কাজলকে নিয়ে নিশ্চিন্দিপুরে ঘর বাঁধবারা সঙ্কল্প নিয়ে গ্রামে প্রত্যাবর্তন। কিছুদিন সেখানে থাকার পর। কাজলকে রানুদির কাছে রেখে অপুর। নিরুদ্দেশযাত্রা। নিশ্চিন্দিপুর ‘অপুকে। বাল্য-জীবনে কবি করিয়াছিল—প্রৌঢ় বয়সে তাহাকে দার্শনিকের ও যােগীর ধ্যানদৃষ্টি উপহার দিয়া তাহার দিগবিজয়-যাত্রার পাথেয় সঞ্চয় । করিয়া দিল। এই উচ্চতম দার্শনিক সুরেই এই মহাকাব্যের ন্যায় বিরাট উপন্যাসের পরিসমাপ্তি।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।