ভূমিকা এ দেশের সব ক্ষুদ্র পল্লীতেই সমাজ নামক অতি ক্ষুদ্র এই দেবতাটি বাস করেন। শরৎচন্দ্র অনেকবার তার দেখা পেয়েছিলেন। যেমন তাঁর বহুপঠিত 'মহেশ' গল্পটি। কাশীপুর গাঁয়ের হতদরিদ্র জমিহীন ভাগচাষী গফুর সপ্তাহে দিন তিনেকের বেশি খেতে পায় কিনা সন্দেহ। পোষ্য বলদ মহেশকে খেতে দেওয়া তো অতি দূরের কথা। তার ওপর বৈশাখের রোদে মাঠ ফুটিফাটা, গাছে পাতা বা মাটিতে ঘাস পুড়ে ছাই, পুকুরে জল পর্যন্ত নেই। অথচ সেই অনাহারক্লিষ্ট বলদকে রোদে বেঁধে রাখলে গাঁয়ে সম্ভাব্য গোহত্যার পাপ বর্তাবে! পরম হিন্দু জমিদার গফুরকে আস্ত রাখবেন না, এই বলে তর্করত্ন শাসিয়ে যান। বোবা অসহায় খেতে-না-পাওয়া মহেশের জন্যে এই অবোধ পিতৃবৎ স্নেহের কারণে তাকে গফুর গোহাটায় বেচেও আসতে পারে না। কখনও খোঁয়াড়ে ধরা পড়লে কাঁসার থালা বাঁধা রেখে তাকে ছাড়িয়ে আনে। সেই মহেশ খিদের তাড়নায় দড়ি ছিঁড়ে জমিদারের বাগান নষ্ট করল, আরও অনেক উৎপাত করল। শেষ পর্যন্ত আমিনার হাত থেকে অনেক কষ্টে-সংগ্রহ-করা জল খেতে গিয়ে কলসী ভেঙে ফেলল – দেখে গফুর ক্রোধে লাঙল দিয়ে তাকে পেটাতে লাগল। সেই আঘাতেই মহেশ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। মহেশের গল্প এইখানেই শেষ। কিন্তু গফুরদের গল্প অত সহজে ফুরোয় না। হিন্দুর গ্রামে গোহত্যা! মহেশকে আঘাত করার আগে জমিদারবাড়ি থেকে গফুর উত্তমমধ্যম প্রহার খেয়েই বিধ্বস্ত হয়ে ফিরেছিল। তার ক্ষুধাতৃষ্ণা ও প্রহারের লজ্জা সব আকস্মিক ক্রোধে রূপান্তরিত হয়ে মহেশের হত্যার কারণ হল। এবার সমাজ নামক ক্ষুদ্র দেবতাটির ক্রোধ জাগ্রত হল 'ম্লেচ্ছ পাষণ্ড' গফুরের উপর। গোহত্যার অপরাধে ভীষণ প্রায়শ্চিত্তের কড়ি গুনতে হবে! সেই ‘প্রাচিত্তিরে’র খরচ জোগাবার ভয়ে রাতের অন্ধকারে জীর্ণ গফুর কন্যা আমিনার হাত ধরে ভাঙাঘর পোড়াভিটে ফেলে গাঁ ছাড়ল—হয়তো ফুলবেড়ের চটকলে কাজ খুঁজতে। 'অনধিকার প্রবেশ' গল্পের সমাপ্তির মতো এ গল্পের শেষে লেখকের কোনো মন্তব্য নেই। আছে ব্যর্থ উৎপীড়িত ছোটলোক মুসলমান গফুরের গলায় : “আল্লা! আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেচে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনও মাপ কোরো না।” গ্রামের সেই অতিক্ষুদ্র সমাজদেবতাদের দৃষ্টি এড়িয়ে হতভাগ্য গফুরদের এই প্রার্থনা আল্লা পর্যন্ত বোধহয় কোনোদিনও পৌঁছতে পারে না। এ তো গেল পশুর উপর মানুষের ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক নিষ্ঠুরতার দিক। শাস্ত্রীয় আনুগত্যের ভণ্ডামি আর ধর্মের নামে ঘৃণা ছড়ানোর এই কারবার চলে গরিব আর দুর্বলকে শোষণের জন্যে—মানুষ আর পশু উভয়েই তার কাছে সমান। আর রবীন্দ্রনাথের অন্য লেখায় যে হৃদয়ধর্মে'র কথা বলা হয়েছে, তা একটা মহিষকেও ‘পুঁটুরানী' করে স্নেহের ডাকে বাঁধে। সে হৃদয়ধর্মে গোরু-মোষ ছাগল-ভেড়া হাতি-ঘোড়া কুকুর-বেড়াল পর্যন্ত গৃহস্থ-পরিবারের অঙ্গ হয়ে যায়, তাদের নামকরণ হয়, একান্নবর্তী পরিবারে কোনো কোনো প্রজন্ম-ভুক্ত হয়। সেই পারিবারিক হৃদয়ধর্ম একশো বছর আগে সচ্ছল গৃহস্থ-বাড়িতে, কী গ্রামে কী শহরে, প্রায়ই দেখা যেত। যেমন, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘আদরিণী' গল্পে। জেলাকোর্টের নামকরা মোক্তার জয়রাম মুখুজ্যের একটি হাতি ছিল— বিশেষ আত্মমর্যাদার অভিমানে একদা সেটি কিনতে বাধ্য হয়েছিলেন। কয়েক বছর প্রতিপালনের পর মোক্তার মশায়ের আয় হ্রাস পায়, হাতিটির রক্ষণাবেক্ষণ তাঁর পক্ষে কষ্টকর হয়ে ওঠে। কিন্তু ইতিমধ্যে আদরিণী ঘরের মেয়েতে পরিণত; তাকে বেচে দেওয়ার চিন্তায় জয়রামের পিতৃহৃদয় হাহাকার করে। পশুহাটে অবশ্য হাতির দাম পাওয়া যায় না, আদরিণী ফিরে আসে। অন্য একটি দূরবর্তী হাটে বেচতে পাঠাবার কালে ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে হাতিটির মৃত্যু ঘটে। জয়রাম মনে করেন, কন্যার কাছে প্রতারণার অপরাধেই হাতিটির অপমৃত্যু ঘটল। এই মৃত্যুর দায়িত্ব বহন করে অল্পকাল পরে অপরাধ-তাড়িত মোক্তার মশায়েরও মৃত্যু ঘটে। গৃহপালিত হাতির প্রতি এই প্রীতি নিছক পশুপ্রীতি নয়। সেকালে সচ্ছল গৃহস্থ মধ্যবিত্তের একান্নবর্তী পরিবার প্রতিপালনের এটি একটি সদর্থক দিক, যেখানে একটি গৃহপালিত পশুও মনুষ্য-গৃহস্থের প্রাপ্য স্নেহবাৎসল্য ও ব্যবহার লাভ করত।
রবীন্দ্রনাথ পশুর প্রতি মানবমনের স্নেহধর্মের কথা লিখেছিলেন, সে একশো দশ বছর আগে। শরৎচন্দ্রের 'মহেশ', প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের 'আদরিণী' লেখার পরও কমবেশি প্রায় আট দশক কেটে গেছে। বাঙালি মধ্যবিত্তের হাতি বা ঘোড়া পোষার দিন আর নেই। কিন্তু জীব-জীবনের প্রতি গৃহস্থের আত্মীয়-বাৎসল্য ও স্নেহ-প্রীতি-মমতার দিন শেষ হয় না। সেই চিরন্তন হৃদয়ধর্মের কাহিনী বলেই 'মহেশ' ও 'আদরিণী' আজও আমাদের চোখ সজল করে।
Provatkumar Mukhapadhaya- (১৮৭৩-১৯৩২) জন্ম বাংলায়, কিন্তু লেখাপড়া মূলত বিহারে। পাটনা কলেজ থেকে বি এ পাশ করে (১৮৯৫) ভারত সরকারের নানা ধরনের কর্মেও বাংলার বাইরে অনেককাল কাটান। লেখালিখির শুরুও ১৮৯৫ সালের দিকেÑ প্রথমে কবিতা, পরে রবীন্দ্রনাথের কুন্তলীন পুরস্কার তিনিই লাভ করেন (১৮৯৭)। সাহিত্যচর্চার সূত্রে ভারতী-সম্পাদিকা সরলা দেবীর সঙ্গে পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা হয়। তার ফলেই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের অর্থানুকূল্যে দুই পুত্রের এই বিপদে পিতার পক্ষে বিলেত যাওয়া (১৯০১) এবং ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরা (১৯০৩) সম্ভবপর হয়। তবে মায়ের অনুমতির অভাবে ঈস্পিত বিয়ে হতে পারেনি। প্রভাতকুমার কিছুকাল দার্জিলিং, রংপুর ও গয়ায় আইনব্যবসা করেন। তারপর নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ের উৎসাহে মানসী ও মর্মবাণী পত্রিকা-সম্পাদনার সঙ্গে দীর্ঘকাল যুক্ত থাকেন (১৯১৬-২৯)। মাহারাজারই চেষ্টায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন-কলেজে শিক্ষকতার কর্ম লাভ করেন (১৯১৬-৩৩)। প্রভাতকুমার বিশেষ সিদ্ধি অর্জন করেছিলেন ছোটোগল্প-রচনায়। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পরেই তাঁর স্থান স্বীকৃত হয়েছিল। তিনি বাস্তব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কিন্তু তার গভীরে প্রবেশ করেননি, এমন কথা বলা হয়ে থাকে। তবে দেশ ও বিদেশের পটভূমিকায় তিনি বহু ঘটনা ও চরিত্র এমনভাবে স্থাপিত করেছেন যাতে তারা প্রাণের স্পর্শ লাভ করেছে। তাঁর গল্পের সরসতা অনেক সময়ে প্রকাশলাভ করেছে রঙ্গ ও ব্যঙ্গের মধ্য দিয়ে, তাই বলে গুরুতর ও বেদনাবহ গল্প যে তাঁর নেই, তা নয়। তাঁর গল্পগ্রন্থের সংখ্যা ১২, উপন্যাসের ১৪। প্রভাতকুমারের উপন্যাস সম্পর্কে সমালোচকেরা সাধারণত একমত যে, তাঁর ছোটোগল্পের শিল্পাচাতুর্য তাঁর উপন্যাসে নেই। তিনি জীবনকে দেখেছেন উপর থেকে, জীবনের গভীরতায় প্রবেশ করেননি। তাই এতে যত ঘটনা আছে বা চরিত্র আছে, তুলানায় তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ নেই, অনেক সময়ের ধারাবাহিকতা নেই। তাঁর উপন্যাসে নাটকের গুণ আছে, উপন্যাসের সমগ্রতা অনুপস্থিত। ‘তিনি প্রথম শ্রেণীর ঔপন্যাসিক নহেন’Ñএকথা বলেও শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বাংলা উপন্যাসে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর উপন্যাসের বিরূপ সমালোচনা-প্রসঙ্গে প্রভাতকুমার নিজেই বলেছেন যে, যে-ধরনের ঐক্য (Unity of action) সমালোচকেরা তাঁর রচনায় সন্ধান করেছেন, তা বস্তুত নাটকে প্রত্যাশিত, উপন্যাসে নয়। তিনি ডিকেনসের উপন্যাসের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, খ- খ- চিত্র সেখানে উপন্যভসের সমগ্রতা লাভ করেছে। বড়োর সঙ্গে ছোটোর এমন তুলনা করায় প্রভাতকুমার ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু আমরা লক্ষ করি যে, একই সমালোচকেরা তাঁর কোনো উপন্যাসে চরিত্রসৃষ্টির প্রশংসা, কোথাও-বা ঘটনাবিন্যাসের গুণকীর্তন করেছেন। প্রভাতকুমারের যে-দুটি উপন্যাসকে সমালোচকেরা তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনার মর্যাদা দিয়েছে, তার মধ্যে একটি রতœদীপ, অপরটি সিন্দুরকৌটা। রতœদীপের কাহিনির বাস্তব ভিত্তি থাকা সম্ভবপর। কোনো প্রতারক কোথাও নিরুদ্দিষ্ট ব্যক্তির স্থান অধিকার করার চেষ্টা করেছে, এমন ঘটনা বিরল নয়। তবু সে-ধরনের ঘটনা কী পরিণতি লাভ করে, তা জানতে আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করি। ঘটনাসংস্থানে প্রভাতকুমার এখানে যেমন বৈচিত্র সৃষ্টি করেছেন, দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন, চরিত্রসৃষ্টিতেও তাঁর নৈপুণ্য তেমনি স্বতঃ প্রকাশিত। রাখাল প্রতারণা করতেই এসেছিল বটে, কিন্তু বৌরাণীর পাতিব্রত্য তাকে শেষ পর্যন্ত অন্যপথে চালিত করে। তার সংযম উচ্চ আদর্শের দ্বারা প্রণোদিত নয়, নিষ্পাপ বৌরাণী প্রতি আন্তরিক প্রণয়সঞ্চারই তার কারণ। এই মানবিকতাই রাখাল চরিত্রকে বাস্তবের সীমারখোর মধ্যে মহত্বদান করেছে। বৌরাণীর পাতিব্রত্যের মূল তার সংস্কারে, এ-কথা যেমন সত্য, তেমনি তার স্বাভাবিক কোমলতা এবং সংসারের মাধুর্যবঞ্চনাজনিত দুঃখবোধ একসঙ্গে মিলে সে-পতিপ্রেমকে বিশিষ্ট করে তুলেছে। রাখালকে স্বামী বলে জানার পর তার প্রতি ধাবমান প্রেমকে বৌরাণী যেভাবে ভুল-ভাঙার পর ফিরিয়ে এনেছে, তা তার চরিত্রের ট্রাজিক পরিণামকেই প্রকাশ করেছে। খগেনকেও লেখক অবিমিশ্র পাষ- করে আঁকেননিএজন্যও তিনি সমালোচকদের প্রশংসা লাভ করেছেন। রত্নদ্বীপ উপন্যাসে পাপ-পুণ্যের তৌল বিচার প্রভাতকুমার করেননি। পাপের প্রতি নাহলেও দুষ্টের প্রতি তিনি সহানুভূতি বোধ করেছেন। মানুষের প্রবৃত্তির নিন্দা তিনি করেননি, প্রবৃত্তির আকর্ষণের মাধুর্য সত্ত্বেও প্রয়োজনে তা যে মানুষ জয় করতে পারে, ঔপন্যাসিক তা-ই দেখিছেন। রত্নদ্বীপের পরিণামে ঠিক পুণ্যের জয় দেখানো হয়নি, মানুষেরই মনেই বিরুদ্ধভাবের সমাবেশ তাকে কখন কোন দিকে নিয়ে যায়, তা-ই এতে দেখানো হয়েছে। রাখাল ও বৌরাণী উভয়ের চরিত্রে যে বিজন মনুষ্যত্ব আছে, পাঠক তাকেই সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করছে এবং উপভোগ করেছে। আনিসুজ্জামান, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়