নাগরিক হিসেবে আমাদের যেমন কিছু অধিকার আছে, তেমনি রাষ্ট্র ও সমাজ, এমনকি পরস্পরের প্রতি কর্তব্যও আছে। এই অধিকার ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতনতা উন্নত সমাজের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য। এমনিতে একজন নাগরিক তাঁর পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন সময় বিক্ষিপ্তভাবে নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব সম্বন্ধে ধারণা বা জ্ঞান লাভ করেন। তবে তা অনেক সময় নাগরিকের মনে স্থিতি পায় না। আমাদের বাংলাদেশের সংবিধানে নাগরিকদের অধিকার ও দায়িত্বে অবহেলার শাস্তির বিধানাবলি উল্লেখিত আছে দণ্ডবিধিতে। কিন্ত সকল নাগরিকের পক্ষে তো সব সময় সংবিধান, দণ্ডবিধি ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থর পাতা ওল্টানো সম্ভব নয়। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মজীবন ইত্যাদি সম্পর্কে জানাও একজন নাগরিকের পক্ষে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এত সব জরুরি জ্ঞাতব্য বিষয়কে একটি গ্রন্থের পরিসরে আবদ্ধ করে সাধারণ নাগরিকদের কাছে সহজলভ্য করে তলিতে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর জীবনের একেবারে শেষ দিকে আমাদের জন্য এই বইটি রচনা বা সংকলনের কাজে হাত দিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে বইটি প্রকাশ করতে পেরে আমরা কৃতার্থ বোধ করছি।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের একজন অন্যতম শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও বিচারক। ১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী মুহাম্মদ জহির উদ্দীন ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং আইনজীবী। শৈশব থেকেই রাজনৈতিক বিষয়াদি ও সংস্কৃতির দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর তাঁরা তৎকালীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পরবর্তীতে রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে বি.এ. (সম্মান) এবং ১৯৫১ সালে এম.এ. পাস করেন। এরপর ১৯৫৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তাঁর কর্মজীবনের শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে যোগ দিয়ে। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের। সহকারী এডভোকেট জেনারেল, হাইকোর্টের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য পদে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৭৬ সালে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হন। ১৯৮৫ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলাকালীন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একাধারে একজন আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ এবং অভিধানপ্রণেতা। তিনি একজন ভাষা সৈনিক; ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর বই সমূহ ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ। তিনি উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বই সমূহ হলো ‘রবীন্দ্র সম্বন্ধে সঞ্জনা ও পার্থক্য বিচার (১৯৬৮)’, ‘যথা-শব্দ (১৯৭৪)’, ‘কোরআন সূত্র (১৯৮৪)’, ‘ভাষার আপন পর (২০১২)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা ৪০টি। সাহিত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (১৯৮৪), একুশে পদক (২০০৭) সহ আরো বেশ কিছু সম্মাননায় ভূষিত হন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর বই সমগ্র পাঠকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।