"কর্ম গুণেই সুখ-দুঃখ" বইটির 'পূর্বকথা' অংশ থেকে নেয়াঃ মহান আল্লাহ রাব্বল আলামীন তাঁর প্রিয়নবীর মাধ্যমে বিশ্ব মানবতার ইহ ও পরলৌকিক কল্যাণের নির্দেশিকা হিসাবে যে মহাগ্রন্থ নাযিল করেছেন, সেই আল কুরআনুল কারীমে ঘােষণা করা হয়েছে যে, “মানুষকে এজন্য সৃষ্টি করা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখেই মানুষের এ জগতে পদার্পণ।” নিছক ভােগতৃপ্তি আর জৈবিক জাহিদা মিটিয়ে দুনিয়াবী জীবন অতিবাহিত করলে মানব জীবনের উদ্দেশ্য সফল হবে না। আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত দয়া পরবশ হয়ে মানুষকে তার দুনিয়াবী জীবনের প্রধান কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছেন। কিন্তু শয়তানের কুহেলিকায় পড়ে মানুষেরা সবাই আম্বিয়ায়ে কেরামের উপদেশ মেনে নেয়নি। যারা তাঁদের অনুসরণ করেছে তাদের জন্য তাে আল্লাহর নিকট রয়েছে। অফুরন্ত নেয়ামত রাজি। আর যেসব হতভাগা অবাধ্য হয়েছে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে সীমাহীন দুঃখ যাতনার আয়ােজন। আম্বিয়ায়ে কেরামের নির্দেশিত কর্ম ও জীবন প্রণালীর সুফল আখেরাতে ছাড়াও দুনিয়াতে বর্তাবে। তেমনি তার অবাধ্যাচরণের কুফলও দুনিয়াবী জীবনে স্বল্প মাত্রায় হলেও প্রতিফলিত হবে। আল্লাহপাক কুরআন মজীদে মুমিন বান্দাদের দুনিয়ায় আনন্দময় জীবন এবং কাফেরদের বিপন্ন জীবনের কথা জানিয়ে দিয়েছেন। কোন কোন ভাল কাজের সুফল এবং কোন কোন মন্দ কাজের কুফল দুনিয়াতে বর্তাবে কুরআন ও হাদীসে তা উল্লেখ রয়েছে। হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) এই সমুদয় কাজের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণী পেশ করেছেন। জাযাউল আমাল নামের সেই পুস্তিকাখানিরই সরল বঙ্গানুবাদ পেশ করা হচ্ছে- “কর্মগুণেই সুখ দুঃখ” নামে। আশা করি হযতর থানভী (রহ) এর বরকতময় গ্রন্থনা অন্যগুলাের মত এটাও মুসলিম মিল্লাতের হিদায়েতের ওছিলা হবে।” শেষদিকে সংযােজন করে দেয়া হয়েছে প্রথম হযরতজী মাওলানা ইলিয়াছ (রহঃ) এর নির্দেশে মাওলানা ইহতেশামুল হাসান কর্তৃক রচিত। আরেকটি পুস্তিকা মুসলমানদের বর্তমান অধঃপতনের কারণ ও তার একমাত্র প্রতিকার।”
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর গন্ডি পেরিয়ে যিনি হাজারো মানুষকে দিয়েছেন আত্মশুদ্ধি ও তাসাওউফ এর শিক্ষা। যার কারণে তাঁর উপাধি ছিলো ‘হাকীমুল উম্মাত’ বা উম্মাহর আত্মিক চিকিৎসক। উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে সুন্নতের জ্ঞান প্রচারে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘দাওয়াতুল হক’ এর অবদানের জন্যও প্রসিদ্ধ মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর নাম। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ১৯ আগস্ট, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে (রবিউস সানী ৫, ১২৮০ হিজরী) ভারতের উত্তর প্রদেশের থানাভবনে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই হাফেয হোসাইন আলী রাহ.-এর কাছে সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। নিজগ্রামেই ছোটবেলায় হযরত মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ থানভী রাহ.-এর কাছ থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১২৯৫ হিজরীতে তিনি দারূল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোয় বিচরণ করার আগ্রহে। সেখানে তিনি পাঁচ বছর হাদীস, তাফসীর, আরবি সাহিত্য, ইসলামী দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, ইসলামি আইন এবং ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দে শিক্ষার অধ্যায় সমাপ্ত করে মক্কা মুকাররমায় মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কীর কাছে কেরাত ও তাজবীদ শেখেন। তিনি কানপুরের একটি মাদ্রাসায় মাত্র ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষকের পদ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কানপুরের টপকাপুরে জামিউল উলূম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালকের আসন অলংকৃত করেন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তাঁর শিক্ষক হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর রহ. পরামর্শে তিনি থানা ভবনের খানকাহে ইমদাদিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। সারা জীবনে আশরাফ আলী থানভী এর সকল বই এর হিসেব করতে গেলে ছোট-বড় মিলিয়ে তা সাড়ে বারো হাজার ছাড়িয়ে যায়। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমূহ এর মধ্যে ফিকাহ বিষয়ক বই ‘বেহেশতী জেওর’ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বহুল পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত কুরআন শরীফের উর্দু তরজমার গ্রন্থ বয়ানুল কুরআনও (কুরআনের ব্যাখ্যা) এর ভাষা ও ব্যখ্যাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমগ্র এর স্বত্ত্ব তিনি জাতির কল্যাণে উন্মুক্ত করে রেখে গেছেন। জুলাই ১৯, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৬ রজব, ১৩৬২ হিজরী) আল্লামা থানভী রহ. তাঁর জন্মস্থান থানা ভবনেই মৃত্যুবরণ করেন।