শিল্পসফল একটি নাট্যোপন্যাস; একটি সমাজ-দর্পণ পটভূমি, চরিত্র, বিষয় ইত্যাদি; সংগ্রহণ করা হয়েছে গ্রামীণ জীবন থেকে। পটভ‚মি: প্রত্যন্ত ভাটি-অঞ্চল; চরিত্র: একদিকে শোষিত-দরিদ্র গ্রামবাসী, আর অন্যদিকে শঠ-প্রতারক-শোষক ভূস্বামী; বিষয়: একদিকে, যুগ যুগ ধরে শিকড়-গাড়া প্রচলিত ছলচাতুরির সঙ্গে অপ্রচলিত জীবনাকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্ব। দুই প্রতিপক্ষের সরাসরি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ঘটনাবহুল কাহিনী। লোভ-ঈর্ষা-ক্ষোভ, বিশ্বাস-ভয়-প্রভুত্ব, কামনা-বাসনা-লালসা―এসব প্রবৃত্তি মানুষের মনে অবস্থান করার কারণে বিচিত্রময় হয়ে উঠেছে এর ঘটনা। স্বার্থান্ধ মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াগুলো এখানে রূপ লাভ করেছে। ভাটিদেশের বাস্তব-চিত্র হিসেবে এই নাট্যোপন্যাসটি অত্যন্ত মূল্যবান। এই নাট্যোপন্যাসের নামকরণের ক্ষেত্রেও এই অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে; যা যুক্তিযুক্ত ও সার্থক হয়েছে। ভাটিদেশের লোকজীবনে অসামান্য প্রভাব, নিবিড় সম্পর্ক এর পরতে পরতে আঁকা হয়েছে। সমাজসচেতনতা বৃদ্ধির মানসে এই নাট্যোপন্যাসের সৃষ্টি। ভাটিদেশের রূপসৌন্দর্য, প্রকৃতি ও সামাজিক তাৎপর্য উপাখ্যানে রূপায়িত করাই এর আরেক উদ্দেশ্যে।
এই নাট্যোপন্যাসের শিল্পমূল্য বিচারের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে উপস্থাপন করা যায়। যেমন―(এক): ঘটনা সংস্থান একেবারেই স্বতন্ত্র; (দুই): ভাটিদেশের, যথার্থ এক চিত্র না হলেও, একটি অংশবিশেষের নিখুঁত চিত্র তৈরি করা; (তিন): ভাটিদেশের গ্রামীণ-সমাজের মানসিকতার এক উজ্জ্বল প্রতিবিম্ব; (চার): এর সূচনা ও যবনিকা-পতনে এক ধরনের নাটকীয়তার ইঙ্গিতময়তা।
এই নাট্যোপন্যাসের শিল্পসাফল্য বিচারের ক্ষেত্রে চরিত্র-চিত্রণ কুশলতা নিরীক্ষণ করা আবশ্যক। যেমন―(এক): প্রতিটি চরিত্রই ছবির মতো সম্পূর্ণ ও নিভাঁজ; (দুই): প্রতিটি চরিত্রই স্ব-স্ব অভিব্যক্তিতে সার্থক, নিষ্পেষিত নিশ্চুপ জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, সমাজে প্রাণ সঞ্চারে জাগ্রত। ননী: এই নাট্যেপন্যাসের স্তম্ভ। শুরু থেকে শেষপর্যন্ত তার বিচরণ। সে ভাটিদেশের একজন ঘেটুপুত্র। শংকরকে ভীষণ ভালোবাসে। শংকরের কাছে প্রতিনিয়ত নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ও সঙ্গীপরায়ণতা প্রমাণ করার জন্য তৎপর থাকে। নায়েব মহাশয় যখন ক্ষিপ্ত হয়ে ননীকে ধমকের সুরে তিরস্কার, ব্যঙ্গবিদ্রূপ করে তখনও সে শংকরকে অনাদর ও অবহেলা করতে পারেনি। নায়েব মহাশয়ের গালমন্দের প্রতিবাদ ঠিকই করে। শংকরের দেখাশোনা ও সেবাযত্নের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি সে। সে ঘরবাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখে। রান্না করে। জামাকাপড় কেচে দেয়। এভাবে শংকরের বাড়ির লোকজনের মাঝে সে একটি স্থান করে নেয়। তবে সে থেকে যায় শংকরের নিয়ন্ত্রণে, কোনও অবস্থায়ই তার নির্দেশ অমান্য করে না। সে অবশ্য চঞ্চল স্বভাবের যুবক। শংকরও তার চাঞ্চল্য ও উচ্ছলতাকে দমন করতে ব্যর্থ। কারণ, ননী প্রথাকে টিকিয়ে রাখতে চায় না, চায় সোহাগ, চায় অপ্রতিহত প্রেমের অধিকারী হতে। তাই এমন কোনও কাজ নেই শংকরের প্রেম লাভের জন্য করে না। মাঝেমধ্যে সে নিজের উপর ক্ষুব্ধ হয়, প্রতারণাকে সে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতে অস্বীকার করে। সে মানবতাবাদী চরিত্র।
কায়া: ননীর প্রতিচ্ছবি। ননীর মুক্ত আত্মারূপ, হয়তো-বা তার বিপরীত রূপও বটে। সে দার্শনিকের মতো উচ্ছল কথা বলে। সে স্তব্ধ ভীতির জগৎ সৃষ্টি করে, শাসন করে, নিষেধও করে। এই প্রতিচ্ছবির মধ্য-দিয়ে ননীর বিদ্রোহী মানসিকতার ইঙ্গিত প্রকাশিত হয়। এখানে প্রতিচ্ছবিটি হয়ে ওঠে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহী প্রতীক। সে যেকোনও সঙ্কটের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়াতে পারে। সে ননীর চিন্তা ও কর্মের একনিষ্ঠ সমর্থক। কায়াকে রূপকাশ্রয় দিয়ে ননীর অন্য-এক বলবান সত্তার জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে।
কমলিকা: স্নেহ-মমতাপূর্ণ হৃদয়ের একজন নারী। অনুভূতি ও প্রকাশক্ষমতা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবী। সে শংকরের বৌদি ও ঘনশ্যামের স্ত্রী। সে ননীকে পুত্রের মতোই যেন আদর স্নেহ করে, ভালোবাসে। সে ঘনশ্যামের দুঃখ-বেদনার সমব্যথী। ঘনশ্যাম অজ্ঞান হয়ে পড়ার ভণিতা করলে তাকে উন্মাদ হতে দেখা যায়। দেখা যায়, নায়েব মহাশয় যখন খাজনার টাকা পরিশোধের জন্য ঘনশ্যামকে অন্যায়ভাবে শাসন করতে থাকে, তখন সে ঘনশ্যামের মুক্তির জন্য মানসিকভাবে অস্থির হয়ে ওঠে। সে ঘনশ্যামের প্রতি তার একনিষ্ঠ আনুগত্য অটুট রেখেই নিজের দেহদানের মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করে, এই হচ্ছে তার জন্য চ‚ড়ান্ত শাস্তি ভোগ। সে জানে, এই ঘটনাটির পর, সে আর ঘনশ্যামের কাছে ফিরে যেতে পারবে না, তবুও তার স্বামীর মুক্তির জন্য নিজেকে ‘জলের ভিতর জলের বিসর্জন’ দিতে কুণ্ঠিত নয়। পরিবেশ-পরিস্থিতিই তাকে ব্যক্তিত্ববান করে তুলেছে; তাই কমলিকা এই নাট্যোপন্যার আরেক সফল কেন্দ্রিয় চরিত্র।
শংকর: ঘেটুদলের প্রধান। একজন মহাজন। ননীর রক্ষাকর্তা। তার প্রেমে উচ্ছ্বল ননীকে সে যখন অন্যায়ভাবে শাসন করতে শুরু করে তখন থেকেই তার মন কমলিকার দিকে ঝুঁকতে থাকে। সে মানসিকভাবে অস্থির। কড়ির পিছনে ছুটতে অভ্যস্ত। মাঝেমধ্যে ননীকে মায়াকামে বুকে টেনে নেয়। তবে সে তার কর্মকাণ্ডের দ্বারাই ঘেটুনাচ জিইয়ে রাখে।
বায়বাহাদুর: এই নাট্যোপন্যাসের সামন্তবাদী প্রতিনিধিত্বশীল এক চরিত্র। তিনি ভূস্বামী। ভাটিদেশের নেতৃত্ব তারই অধীনে। ঘেটুনাচের উৎসব তার নির্দেশেই অনুষ্ঠিত হয়। তিনি প্রতারণার আশ্রয় স্থাল। তিনি তার দীর্ঘকালের দাম্পত্য জীবনকে অস্বীকার করে পরদেহ ভোগে লিপ্ত হন। তিনি মানবতাবিরোধী শক্তির যর্থাথ প্রতিভ‚। শোষণের শীতল সাম্রাজ্যের সম্রাট। এক মূর্তিমান আতঙ্ক, তবে নিজের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে ননীর হাতে।
নায়েব মহাশয়: ভাটিদেশের একজন মোড়ল। সে রায়বাহাদুরের প্রধান কর্মচারী। সামন্তপ্রভুর অনুগত। খাজনা আদায়ের সুযোগে নিজের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তৃত করে। সে রায়বাহাদুরের অপকর্মের দোসর। সে মানুষের চেতনাকে বিকশিত হতে দেয় না। অধিকারবোধ জাগ্রত হওয়ার যেকোনও পথে সে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। ঘেটুনাচের উৎসবকে কেন্দ্র করে সে দরিদ্র কৃষকের উপর আরও বেশি শোষণ করে। অতএব সে দয়ামায়াহীন মানবতাবিরোধী এক চরিত্র। সে দুর্বলচিত্তের লোক; কারণ তার চরিত্রে কোনওপ্রকার দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায় না, বরং সর্বক্ষেত্রেই তাকে রায়বাহাদুরের কথার সুরে সুর মেলাতে দেখা যায়।
ঘনশ্যাম: শংকরের দাদা। এই চরিত্রে দৃঢ়তার প্রকাশ অল্প, তবে সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী চরিত্রটি যথাযোগ্য মর্যদায় বিকশিত হয়। সে বিপদ ও ক্লেশমুক্ত থাকতে পছন্দ করে। সে তার স্ত্রীর সেবা-শুশ্রূষা তৃপ্তি ভরে উপভোগ করে; প্রয়োজনে ভণিতার আশ্রয় নিতেও কুণ্ঠিত নয়। তবে তার স্ত্রীর চূড়ান্ত শাস্তিভোগের সময় নিঃশব্দে পলায়ন করতে তার কোনও সমস্যা হয় না, যদিও সে কমলিকাকে খুবই ভালোবাসে।
বাঈজী: সে একজন নৃত্য ও সঙ্গীত শিল্পী। এর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় সামাজিক দ্বন্দ্ব, মূল্যবোধের অবক্ষয়, মানবান্তরের অন্তর্দ্বন্দ্ব; যা মানুষের সম্পর্কের মধ্যে থাকে, দৈনন্দিন এবং পারিবারিক জীবনে থাকে, এমনকি একই ব্যক্তির মনোলোকেও থাকে। মানুষের সার্বিক মুক্তি ও স্বাভাবিক বিকাশের আকাঙ্ক্ষা এই চরিত্রের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে প্রকাশ ঘটে। এর সঙ্গে প্রকাশ করা হয়, সাধারণ মানুষকে কিভাবে বিভ্রান্ত করে, লোভ দেখিয়ে শোষণের প্রক্রিয়া সচল রাখা হয়। এই নাট্যোপন্যাসের ভাষা সহজ নয়, আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার শূন্য, তবে সুসংহত শিল্পরূপ ও শিল্পীমনের সজাগ অভিনিবেশে তৎসম, অর্ধ-তৎসম ও কটিন শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতীক ও উপমা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও নূতন মাত্রা যোগ করা হয়েছে। প্রচলিত বাগধারাকেও যথার্থরূপে প্রয়োগ করা হয়েছে। বাগধারা প্রয়োগের একমুঠো উদাহরণ―(১) হৃদয়ে কেটে বসা; (২) হাওয়াশূন্য; (৩) শূন্যকোল; (৪) কথা-পাড়া; (৫) লজ্জা শরমের বালাই; (৬) পঞ্চভ‚তে খাওয়া; ইত্যাদি। উপসংহারে বলা যায় যে, এই নাট্যোপন্যাসটি উপজীব্য বিষয়-বস্তু, চরিত্র-চিত্রণ, ভাষা-প্রয়োগ, কাহিনী-বিন্যাস, প্রতীক-উপমা-বাগধারার ব্যবহার ইত্যাদির সার্থক সমন্বয়ে বাংলা-সাহিত্যের একটি সফল নাট্যোপন্যাস হিসেবে বিবেচিত ও পাঠকনন্দিত।