ভূমিকা প্রবীর ঘোষের ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক' বইটির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হল এমন এক বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তে যখন ধর্মের উন্মাদনা ও সম্প্রদায়গত উন্মাদনা দেশের শ্রমজীবী মানুষদের সংগ্রামী প্রতিবাদী চেতনাকে বিশাল অজগরের মতোই একটু একটু করে গ্রাস করে চলেছে। আমরা একবিংশ শতাব্দীতে যখন পা দিতে চলেছি তখন শাসকশ্রেণি তাদের একান্ত স্বার্থে আমাদের চেতনাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলেছে পঞ্চদশ বা ষোড়শ শতকে। জাত-পাতের নামে, ধর্মের নামে লড়তে নেমেছে নিপীড়িত মানুষের বিরুদ্ধে নিপীড়িত মানুষ। বঞ্চিত, নিরন্ন এই মানুষগুলোকে ‘মুরগি লড়াই’তে নামিয়েছে শাসক ও শোষক শ্রেণি এবং তাদের কৃপায় পালিতেরা। ভাবাবেগে অথবা নিপুণ কৌশলী প্রচারের ব্যাপকতায় যুক্তি আমাদের গুলিয়ে যায়। আমরা বিস্মৃত হই—যে কোনও ধর্মের, যে কোনও জাতের, যে কোনও ভাষাভাষী কালোবাজারি এবং শোষণকারী সাধারণ মানুষের শত্রু এবং শোষক, আর যে কোনও ধর্মের, যে কোনও জাতের, যে কোনও ভাষাভাষী গরিব শ্রমিক-কৃষক গরিবই এবং শোষিত। শোষিত, নির্যাতিত মানুষের নিজেদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে ভাষা নিয়ে, জাত-পাত নিয়ে অনৈক্য সংঘর্ষ শোষক শ্রেণির সুবিধেই করে। তাই শোষক শ্রেণি প্রয়োজনে বার বার শোষিত শ্রেণির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে ধর্ম-ভিত্তিক, ভাষা-ভিত্তিক, জাত-পাত ভিত্তিক উত্তেজনা ও উন্মাদনার সৃষ্টি করে। সংরক্ষণবাদের তকমা এঁটে যাঁরা নিপীড়িত জনগণের মুক্তির কথা বলেন, তাঁরা বিভেদকামী, মিথ্যাচারী, ধান্দাবাজ ও শোষকশ্রেণির দালাল ছাড়া কিছু নয়। নিপীড়িত শ্রমিক-কৃষকের মুক্তি সংরক্ষণের হাত ধরে কোনও দেশে কখনও আসেনি, আসতে পারে না। বর্তমানে এদেশে সাম্প্রদায়িকতার যে বিপুল উত্থান ঘটেছে, তার কারণ সাম্প্রদায়িকতাবাদ ধর্মকে অবলম্বন করে এমনই এক রাজনৈতিক দর্শন, যে দর্শন অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই দর্শনকে পুষ্টি জোগাচ্ছে শোষক শ্রেণির প্রতিনিধি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এই কঠিন সময়ে একান্তভাবে প্রয়োজন এক দীর্ঘস্থায়ী সুপরিকল্পিত মতাদর্শগত সংগ্রামের। আর তারই প্রয়োজনে একান্ত কাম্য সাধারণের চেতনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, কুসংস্কারমুক্ত, সমাজ সচেতন নতুন এক সাংস্কৃতিক পরিবেশ তৈরি করা। এমনই এক প্রয়োজনের কথা মনে রেখেই বিজ্ঞান আন্দোলনের নেতা, বিশিষ্ট সমাজসেবী প্রবীর ঘোষ সংস্কারমুক্ত নতুন সমাজ গড়তে লেখনি তুলে নিয়েছেন। ধর্মান্ধতা বিরোধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এবং সংস্কারমুক্ত সুস্থ সমাজ গঠনে ভূমিকা গ্রহণকারীদের কাছে এই বইটি অবশ্যই একটি জোরালো হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হবে ।
প্রবীর ঘোষ ( Prabir Ghosh, জন্ম ১ মার্চ, ১৯৪৫) কলকাতাভিত্তিক ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির প্রধান এবং হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি। একদা তিনি প্রচারমাধ্যমে ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখিত হতেন। তিনি বেশকিছু জ্যোতিষবিদ ও অলৌকিক শক্তি অধিকারী বলে দাবি কৃত ব্যক্তিদের প্রচারণার অসারতা প্রমাণ করেছেন। যার মধ্যকার কয়েকটি ঘটনা নিয়ে চ্যানেল ফোর 'Guru Busters' নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছে। তিনি যুক্তিবাদ প্রসার সহায়ক ও অলৌকিকতা বিরোধী একাধিক গ্রন্থের লেখক। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলোর মধ্যে আছে: অলৌকিক নয় লৌকিক( ৫ খন্ডে সমাপ্ত),জ্যোতিষীর কফিনে শেষ পেরেক,সংস্কৃতিঃ সংঘর্ষ ও বিনির্মাণ,আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না,পিংকি ও অলৌকিক বাবা,অলৌকিক রহস্য জালে পিংকি,ধর্ম-সেবা-সম্মোহন,গোলটেবিলে সাফ জবাব ইত্যাদি।