ভূমিকা স্নেহভাজন কে. আশরাফুল আলম ২০০৮ সালের দিকে “ভূগোল ও পরিবেশকোষ” নামক তাঁর সদ্য প্রকাশিত একটি বই আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। একক প্রচেষ্টার একটি বড় এবং চমৎকার কাজ দেখে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম এবং বইটির একটি আলোচনা লিখবো বলেছিলাম। কিন্তু অধ্যাপনার কাজ ছেড়ে প্রশাসনিক কাজে খুব বেশি জড়িত হয়ে পড়ায় সময়ের অভাবে আলোচনাটি আর লেখা হয়নি। প্রায় ৫ বছর পর আবার 'জলবায়ুবিজ্ঞান' নামক পুস্তকের পাণ্ডুলিপি নিয়ে হাজির হয়ে পুরানো কথা মনে করিয়ে দিলেন। বাংলাভাষায় ভূগোল চর্চা শুরু হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে। এ দীর্ঘ সময়ে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বাংলা ভাষায় ভূগোল পুস্তক রচনা করেছেন। ফলে বাংলাভাষায় মানসম্পন্ন ভূগোল পুস্তকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। জলবায়ুবিজ্ঞান হচ্ছে প্রাকৃতিক ভূগোলের শাখাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গতিশীল। কারণ এটি বায়ুমণ্ডলের সাথে সম্পর্কিত এমন সব বিষয় নিয়ে কাজ করে যা সময়গত ও পারিসরিকভাবে প্রায়শ পরিবর্তিত হয় এবং যা মানুষ ও তার পরিবেশের ওপর ব্যাপকভাবে প্রভাববিস্তার করে। বিশেষ করে বিগত শতকের শেষ দিকে ‘স্যাটেলাইট জলবায়ু' (Satellite Climatology) নামে জলবায়ুবিজ্ঞানের একটি বিশেষ শাখা বিকাশের পর এটি এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বসহকারে আলোচিত হচ্ছে। পাণ্ডুলিপির সূচিপত্রে নতুন কিছু বিষয়ের সন্ধান পেয়ে আগ্রহী হয়ে পাণ্ডুলিপিটি দেখবো বলে রেখে দিলাম। পাণ্ডুলিপির আদ্যোপান্ত বর্ণনায় লেখকের মুন্সিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। এক নজরেই বুঝা যায়, লেখক আধুনিক তথ্য-উপাত্ত সর্বাধিক পরিমাণে ব্যবহারের প্রাণন্ত চেষ্টা করেছেন। দুই যুগেরও বেশি শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের অভিজ্ঞতার আলোকে জটিল বিষয়গুলোকেও প্রয়োজনীয় চিত্র-মানচিত্রসহ সহজবোধ্য করে উপস্থাপন করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম- নীতির সাহায্য ছাড়া জলবায়ু চলকগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে লেখক প্রণালিবদ্ধ আলোচনা করেছেন এবং পাদটীকায় বা অধ্যায় শেষে কতিপয় পরিভাষার ব্যাখ্যা শিরোনামে অনুসন্ধিৎসু পাঠকের জন্য সংশ্লিষ্ট আরও অনেক বিষয়ে অতিরিক্ত ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, যা সন্দেহাতীতভাবে পুস্তকটির বিষয়বস্তুগত সমৃদ্ধি প্রদান করেছে। লেখক জলবায়ু ও পরিবেশ সম্পর্কিত এমন কতিপয় বিষয় আলোচনা করেছেন, যা বাংলা ভাষায় প্রকাশিত কোনো পুস্তকে ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, লেখক একজন আবহাওয়া বা জলবায়ুবিজ্ঞানীর দৃষ্টিভঙ্গিতে নয়, বরং একজন ভূগোলবিদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পুস্তকটিতে অন্তর্ভুক্ত সকল বিষয় আলোচনা করেছেন। আমাদের দেশে পুস্তক রচয়িতাগণ অন্যের লেখা ব্যবহারের সময় খুব কমই পূর্বসুরির রেফারেন্স উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এক্ষেত্রে লেখক কার্পণ্য করেননি, এমনকি চিত্র-মানচিত্রের উৎসগুলোও উল্লেখ করেছেন, যা বইটির গ্রহণযোগ্যতা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলা পরিভাষার পাশাপাশি বন্ধনীতে মূল ইংরেজি শব্দ থাকায় বিদগ্ধ পাঠকের জন্য বিষয়ের গভীরে প্রবেশ অনেক সহজ হবে। এছাড়া পরিশিষ্টে বাংলা পরিভাষাসহ ইংরেজিতে শব্দসূচি প্রদান করায় একজন পাঠককে খুব সহজেই তাঁর উদ্দিষ্ট বিষয়বস্তু খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। বর্তমান সময়ে বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানী, রাষ্ট্র পরিচালক, নীতি নির্ধারক ও সচেতন নাগরিকদের কাছে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন একটি জ্বলন্ত ইস্যু। পুস্তকটিতে এতদ্বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ঠাঁই পেয়েছে। পুস্তকটি যেকোনো পর্যায়ের জ্ঞানানুশীলনকারীর চাহিদা পূরণ করবে বলে আমি আশা করি। আর কোনো পাঠক যদি পুস্তকটি থেকে কিঞ্চিত রসাস্বাদনের সুযোগ নেন, তাহলে লেখকের শ্রম সার্থক হবে।