"ভারত স্বাধীন হল" বইটির ভুমিকা থেকে নেয়াঃ ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার মধ্য দিয়ে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটে এবং বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। ইংরেজরাই হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। আস্তে আস্তে মুঘল সম্রাটদের ওপরও তারা প্রভাব বিস্তার করে। একসময় সমগ্র ভারতবর্ষের ক্ষমতা চলে যায় তাদের হাতে। সেই থেকে ১৯০ বছর তারা শাসনের নামে এদেশের ওপর শােষণ নির্যাতন চালায়। স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্যে আন্দোলন করতে গিয়ে অনেক বিপ্লবীকে জীবন দিতে হয়েছে। একসময় আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ রাজশক্তিকে নমনীয় হতে হয়। ভারতবর্ষকে ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ভারতবিভক্তির মাধ্যমে। কিন্তু কিছু ভারতীয় নেতা ভারতকে বিভক্ত করতে চান না, তাঁরা অখন্ড ভারতের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম নেতাদের নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে বিভক্তির মাধ্যমে ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) রচিত ‘ভারত স্বাধীন হল’ গ্রন্থে এসব বিষয় আলােচিত হয়েছে। মৌলানা সাহেবও চেয়েছিলেন অবিভক্ত স্বাধীন ভারত। ব্রিটিশ-ভারতে কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ওৎপ্রােতভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯২৩ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১৯৪০ সালেও আবার সভাপতি হন। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ কেবিনেট মিশনের সঙ্গে কথাবার্তা চালানাের সময় কংগ্রেস পার্টির পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম সরকারে শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং ১৯৫৮ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। ভারতের স্বাধীনতা এবং বিভক্তি সম্পর্কিত তার অভিজ্ঞতা ও অভিমত নিয়েই রচিত ‘ভারত স্বাধীন হল। বইটি প্রথম প্রকাশিত তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৫৮ সালে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন হুমায়ুন কবীর (১৯০৬-১৯৬৯)। তিনি ছিলেন ইংরেজি ও বাংলায় লেখা দর্শন, সাহিত্য, রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিষয়ক কুড়িটির বেশি গ্রন্থের রচয়িতা। প্রথম জীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মজীবন শুরু এবং পরে সচিব এবং ভারতের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। হুমায়ুন কবীর মৌলানা আজাদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ‘ভারত স্বাধীন হল' বইটি মৌলানা আবুল কালাম আজাদের কাছ থেকে শুনে তিনি ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ করেন। ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে সর্বদলীয় ঐক্যমত্য থাকলেও বিভক্তির প্রশ্নে দ্বিমত ছিল। ভারত টুকরাে টুকরাে হয়ে যাক তা চাইতেন না মৌলানা আজাদ। প্রয়ােজনীয় মতামত প্রকাশের তাগিদ থেকে তিনি ‘আল হিলাল’ নামে একটি উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯১২ সালের জুন মাসে এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। উর্দু সাংবাদিকতার ইতিহাসে ‘আল-হিলাল' প্রকাশ এক যুগান্তকারী ঘটনা। সময়ের মধ্যে এই কাগজ অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে এক বিপ্লবী সাড়া জাগায়। আল-হিলালের সাফল্যে সরকারের পিলে চমকে গেল। প্রেস আইন প্রয়ােগ করে সরকার দুহাজার টাকা জামানত দাবি করে। সরকারের ধারণা ছিল এতে পত্রিকার সুর নরম হবে। কিন্তু হয়নি। সরকার দেরি করে জামানত জব্দ করে নিয়ে নতুন ফন্দি হিসেবে দশ হাজার টাকা জমিন চায়। অচিরে সে টাকাটাও খােয়া গেল। ১৯১৪ সালে শুরু হলাে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৫ সালে ‘আল-হিলাল’ পত্রিকার ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত হলাে। পাঁচ মাস পরে ‘আল-বালাঘ' নামে একটা নতুন পত্রিকা বের করলেন মৌলানা আজাদ। প্রেস আইনে পঁাচে ফেলতে না পেরে সরকার ভারতরক্ষা আইনের আশ্রয় নিয়ে ১৯১৬ সালের এপ্রিল মাসে তাকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করল। ঐ একই বিধি প্রয়ােগ করে পাঞ্জাব, দিল্লি, উত্তর প্রদেশ ও মুম্বাই সরকার ঐসব প্রদেশে তার প্রবেশ রােধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত তিনি রাচি চলে যান এবং ছয় মাস যেতে না যেতেই সেখানে তাকে নজরবন্দি করা হয়। ১৯১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আটক থাকার পর ১৯২০ সালের ১লা জানুয়ারি তিনি নজরবন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি লাভ করেন। ততদিনে ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে মহাত্মা গান্ধীর আবির্ভাব ঘটেছে। ‘ভারত স্বাধীন হল' গ্রন্থে যেসব বিষয় নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে তা হলাে-সরকারে কংগ্রেস, ইউরােপে যুদ্ধ, আমি কংগ্রেস সভাপতি হলাম, একটি চীনা গর্ভনাটিকা, ক্রিপস্ মিশন, অস্বস্তিকর বিরতি, ভারত ছাড়, আমেদনগর ফোর্ট জেল, সিমলা সম্মেলন, সাধারণ নির্বাচন, ব্রিটিশ কেবিনেট মিশন, পাকিস্তানের প্রস্তাবনা, অন্তর্বর্তী সরকার, মাউন্টব্যাটেন মিশন, একটি স্বপ্নের সমাধি, বিভক্তি ভারত, উত্তর ভাগ ও পরিশিষ্ট। এসব বিষয় ছাড়াও ১৯৫৯ সংস্করণের মুখবন্ধ ও পূর্বাভাস অংশে নানা তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ একটি আকরগ্রন্থ ‘ভারত স্বাধীন হল'।
ভারতবর্ষের টানা প্রায় দুইশ বছরের রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের পর ঘটনাবহুল সর্বশেষ সাতটি বছরের প্রধান রাজনৈতিক চরিত্ররূপেই নয় আরো অনেক কারণেও উপমহাদেশের অনন্য চরিত্র মাওলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৭৮-১৯৫৮)। তাঁর জন্ম পবিত্র মক্কায়। বেড়ে ওঠা ও লেখাপড়া কলকাতায় একান্তই ঘরোয়া পরিবেশে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনা না মাড়িয়েও তিনি আধুনিক ও প্রাচীন শিক্ষার শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিতদের ওপর প্রাধান্য অর্জন করেছিলেন কেবল নিজের প্রখর প্রতিভাবলে। কি জ্ঞানবত্তায়, কি সাহিত্য ও সাংবাদিকতায়, কি রাজনীতি ও সংগঠনে সর্বত্রই তিনি একটি অদ্বিতীয় বিপ্লবী চরিত্র। মুসলিম সমাজের তিনি ‘ইমামুল হিন্দ’, হিন্দুপ্রধান ভারতীয় কংগ্রেসের তিনি বরেণ্য সভাপতি। ব্রিটিশ ভাইসরয় ও কূটনীতিকদের সাথে সংলাপে তিনি ছিলেন কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি। তাঁর সম্পাদিত উর্দু সাপ্তাহিক আল-হেলাল-এর জন্য তাঁকে বারবার কারাগারে যেতে হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও নীতিনিষ্ঠায় ভারতবর্ষের অন্য কোনো নেতাই তাঁর সমকক্ষ ছিলেন না । মি. জিন্নাহর পাকিস্তান দাবির সম্মুখে একে একে গান্ধী-নেহরু-প্যাটেল সকলেই নেতিয়ে পড়লেন, কিন্তু‘ তখনো তিনি তাঁর অবদানে অটল ছিলেন । অবশেষে স্বাধীন ভারতে যখন তিনি চরম সাম্প্রদায়িক রাজনীতির রূপায়ন দেখলেন, তখন তাঁর স্বপ্ন ভঙ্গ হলো। এ পুস্তকটি তাঁর সে মর্মবেদনার মূর্তরূপ। এটাকে তাঁর দায়মোচনের প্রচেষ্টাও বলা চলে। রাজনীতিক মাওলানা আজাদের মৃত্যু হলেও যুগস্রষ্টা লেখক ও চিন্তাবিদ বিপ্লবী আজাদ যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে থাকবেন।