"নির্বাচিত সেরা সাত" বইয়ের সংক্ষিপ্ত কথা: কবিতা শুধু চিত্তের মেধাবী লাবণ্য ও কথাছবির উৎসারণই নয়, তা জীবনজগতের লাবণ্যময় সারাৎসারও বটে। এই সারাৎসারে থাকে রাজনীতি-সংস্কৃতি-নারী-প্রেম-মৃত্তিকা-ঐতিহ্য এবং নির্মীয়মাণ বাস্তব ও কল্পসুন্দরের অন্তর্দ্বন্দ্ব। বাংলা কবিতার ধারায় এসবেরই অন্তর্লিখন রয়েছে আধুনিক কবি শামসুর রাহমানের দীর্ঘ কাব্যগাথায়। তিরিশের কবিতার সম্প্রসারণ ঘটিয়ে তিনি কবিতাকে দিয়েছেন বাংলাদেশের জাতিরাষ্ট্রের মানচিত্র, দিয়েছেন কবিভাষার স্বতন্ত্র প্রকাশ। আধুনিক কবির যে উৎসাহ জড়িয়ে থাকে আত্মসন্ধিৎসায় ও মননভাবনায় তার কল্পোক্তিপ্রবণ অন্তর্বয়নে ঋদ্ধ তাঁর কবিতা। এই সংকলনে গৃহীত সাতটি কাব্যগ্রন্থের প্রথম কাব্য প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে থেকে তাঁর যে পথচলার শুরু তাতে লক্ষ করা যায় জীবনানন্দীয় চিত্রময়তার বর্ণগভীরতা, নাগরিক নৈঃসঙ্গ্য, নাগরিক সত্তা ও ব্যক্তিসত্তার দ্বিধাবিভক্তি। ক্রমে তিনি আরও বড় মাত্রায় গভীর বাস্তবে এসে দাঁড়ান রৌদ্র করোটিতে। এখানে তিনি প্রতিমুহূর্তের বর্তমানকে প্রত্যক্ষ করেছেন বিলীয়মান অতীতে, তাঁর ভাবনা, অভিজ্ঞান ও সংবেদন হয়ে উঠেছে কোলাজ, সংলাপিতা ও দৃশ্যচিত্রমালা। কাব্যযাত্রাপথে নিজেকে অতিক্রমের বাঞ্ছায় তিনি ক্রিয়ামুখর, কিন্তু নিজ বাসভূমের স্পেস কখনো ছাড়েন না, ছাড়েন না নিজের নীলিমাচারী মনের উল্লম্ব দিগন্ত ছুঁয়ে-ফেলার বাসনা। নিরালোকে দিব্যরথ চালিয়ে তিনি মুক্তির পরিধি পরিক্রমণ করেন, স্বপ্ন ও সৌন্দর্যের সন্ধান করেন। পথ চলেন কাব্যভাষার উত্তরণ-বাসনার হাত ধরে, নির্মাণ করেন নাগরিক ঢাকার মাপা মাপা ছন্দ। শামসুর রাহমানের কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনস্পন্দনটিকে ছন্দে গ্রথিত করতে পেরেছেন। তাঁকে এশিয়ার শ্রেষ্ঠ কবিও বলা হয়েছে। দীর্ঘ কবিজীবনে যা-কিছু রচনা করেছেন তার কিছু অংশ মাত্র গ্রন্থিত সাতটি কাব্যে প্রতিবিম্বিত, বাকিটুকু রয়ে গেছে অধৃত। কবিতায় অবশ্য কবিকে সবটা ধরা যায় না, যদি না তিনি দেশমৃত্তিকার সঙ্গে আত্মসত্তাকে জড়িত না করেন, এই বিজরন রাগমানের কবিতাকে করেছে অনন্য।
নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানা থেকে আরেকটু ভেতরে মেঘনাপাড়ের গ্রাম পাড়াতলী। কবি শামসুর রাহমানের পৈতৃক নিবাস। তবে জন্মেছিলেন ঢাকা শহরের ৪৬ নম্বর মাহুতটুলির বাড়িতে। তারিখ ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর। দশ ভাইবোনের মধ্যে জেষ্ঠ্য তিনি। ১৯৪৮ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর তখন মননের গহীন তল্লাটে কবিতার যে আবাদভূমি গড়ে উঠেছিল, তা কেবল উর্বরই হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নলিনী।কিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। তারপর দে ছুট। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), সাংবাদিকতার জন্যে পেয়েছেন জাপানের মিৎসুবিশি পদক (১৯৯২), ভারতের আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪) ছাড়াও বহু পুরস্কার। ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। ‘মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে যে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন, একই পেশায় থেকে ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন, তবু খেই হারাননি জীবন, সাহিত্য ও কবিতার পাঠ থেকে। মূলত কবি হলেও সাহিত্যে তাঁর কাজ বহুমাত্রিক। অনুবাদ সাহিত্য থেকে গদ্যের বিভিন্ন প্রশাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।