রাজেনবাবু মানুষটি একটু শৌখিন। শৌখিন মানে বাবু নয়। হাঁটুর কাছে কাপড় তুলে, দু-হাতে দুই ঝুলি নিয়ে বাজার ক'রে আসতে আপত্তি নেই তাঁর; কিন্তু শোবার সময় বালিশে একটু সুগন্ধ চাই। এক জামা প'রে সপ্তাহের ছ'দিন আপিশ করবেন, এদিকে কাচের গেলাশে ছাড়া জল খাবেন না। ঠিকে-ঝি কামাই করলে রাত থাকতে বিছানা ছেড়ে উনুন ধরিয়া রাখবেন, তারপর বারান্দার ভাঙা তক্তায় খালি গায়ে ব'সে গুনগুন করবেন ভৈরবী কি যোগিয়া। পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হ'য়ে, বাপের বাড়িতে এক বছর কাটিয়ে শিশিরকণা প্রথম যখন স্বামীর ঘর করতে এলেন, স্বামীর এ-সব ছোটোখাটো শখগুলি তাঁর মনে বিশুদ্ধ কৌতুক জাগিয়েছিলো। এমনকি, এর কিঞ্চিৎ প্রশ্রয়ও তিনি দিয়েছিলেন বিছানার তলায় অগুরুর শিশি লুকিয়ে রেখে-তার চেয়েও বেশি, ঠিকে-ঝির সাহায্যে সংগৃহীত কয়েকটি পথে-ঝরা বকুল কোনো রাত্রে নিজের আঁচলে বেঁধে নিয়ে। সুগন্ধ ভালো; সুগন্ধের উৎসটা আরো ভালো হ'তে শেষ কী। কয়েক মাস পরে শিশিরকণা যখন অন্তঃসত্ত্বা হলেন, আর রাজেনবাবু বললেন- 'বেশ হালো-ছোট্টো ফুটফুটে একটা মেয়ে হবে- বেশ।' তখন স্বামীর এই নতুন শখটিতে বেশি সুখী না-হ'য়ে তিনি বললেন, 'কেন, মেয়ে কেন?' 'ছেলে হ'লে তো শুধু হাফ-প্যান্ট আর ডাণ্ডাগুলি! আর মেয়ে! রং-বেরঙের ফ্রক, রিবন, কড়া-ঝাঁকড়া কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল-আর, একটু বড়ো হ'লে তো কথাই নেই!' কিন্তু স্বজাতির সংখ্যাবৃদ্ধির সম্ভাবনায় শিশিরকণাকে বিশেষ উৎফুল্ল দেখা গেলো না।
Buddhadeb Bosu- তিনি নভেম্বর ৩০, ১৯০৮ কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। একজন খ্যাতনামা বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গল্পকার, অনুবাদক, সম্পাদক ও সাহিত্য-সমালোচক ছিলেন। ১৯২১ সালে ১৩ বছর বয়সে তিনি ঢাকায় আসেন এবং প্রায় দশ বৎসর ঢাকায় শিক্ষালাভ করেন। বুদ্ধদেব বসু ১৯২৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯২৫ সালে ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম বিভাগে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। ১৯২৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে ঢাকা কলেজ) থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে আই. এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে থেকে ইংরেজিতে ১৯৩০-এ প্রথম শ্রেণীতে বি. এ. অনার্স এবং ১৯৩১-এ প্রথম শ্রেণীতে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী এক ছাত্র। বি. এ. অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর লাভ করেন তা একটি রেকর্ড; এবং অদ্যাবধি (২০০৯) এ রেকর্ড অক্ষুণ্ণ আছে। তাঁর পিতা ভূদেব বসু পেশায় ঢাকা বারের উকিল ছিলেন। তাঁর মাতার নাম বিনয়কুমারী। বুদ্ধদেব বসুর মাতামহ চিন্তাহরণ সিংহ ছিলেন পুলিশ অফিসার। তাঁর পৈতৃক আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের মালখানগর গ্রামে। জন্মের চব্বিশ ঘণ্টা পরেই তাঁর মাতা বিনয়কুমারীর ১৬ বছর বয়সে ধনুষ্টঙ্কার রোগে মৃত্যু ঘটে। এতে শোকাভিভূত হয়ে তাঁর পিতা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করেন। মাতামহ চিন্তাহরণ ও মাতামহী স্বর্ণলতা সিংহ'র কাছে প্রতিপালিত হন বুদ্ধদেব। বুদ্ধদেবের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের প্রথমভাগ কেটেছে কুমিল্লা, নোয়াখালী আর ঢাকায়। অল্প বয়স থেকেই কবিতা রচনা করেছেন, ছেলে জুটিয়ে নাটকের দল তৈরি করেছেন। প্রগতি ও কল্লোল নামে দু'টি পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা সম্বল করে যে কয়েকজন তরুণ বাঙালি লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরজীবদ্দশাতেই রবীন্দ্রনাথের প্রভাবের বাইরে সরে দাঁড়াবার দুঃসাহস করেছিলেন তিনি তাঁদের অন্যতম। ইংরেজি ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধাদি রচনা করে তিনি ইংল্যান্ড ও আমেরিকায়ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। তিনি মার্চ ১৮, ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।