ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথা প্রতিদিন সারা দেশে থেকে শয়ে শয়ে চিঠি পান রবীন্দ্রনাথ। যথাসম্ভব সেগুলির উত্তরও দেন তিনি।একদিন একটি চিঠি পেয়ে নিতান্তই কৌতূক অনুভব করলেন কবি।রাণু নামের বারো বছরের এক বালিকা বারাণসী থেকে লিখেছে।এই বয়সেই সে কবির অনেক লেখা পড়েছে।তিনিই তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ।বালিকার অনুযোগ, কবি ইদানিং এত কম গল্প লিখছেন কেন? কবি সেই বালিকার চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন। সাংসারিক জীবনে রবীন্দ্রনাথ কোন ওদিন অপার শান্তি পাননি।হঠাৎই একদিন বহু রোগভোগের পর কবির প্রিয় জ্যেষ্ঠ কন্যা মাধুরীলতা মারা গেল। ভেঙে পড়লেন কবি। সেদিনই অশান্ত মনে ভাড়া-করা গাড়িতে এলেন ভবানীপুরে। নম্বর মিলিয়ে একটি বাড়ির সামনে এসে চেঁচিয়ে ডাকলেন, রাণু!রাণ! তরতরিয়ে নেমে এল এক বালিকা। কবির চোখে পলক পড়ে না।এ কাকে দেখছেন তিনি? এ পরী, না স্বর্গের অস্পরা!সেদিনই আটান্ন বছর বয়সী কবির সঙ্গে এই বালিকার এক অদ্ভুত সম্পর্ক রচিত হয়ে গেল।রাণূ হয়ে উঠল কবির খেলার সঙ্গী, নব নব লেখার প্রেরণাদাত্রী, হারানো ‘বউঠান।’ আর রাণুর কাছে কবি প্রিয় ভানুদাদা। তার একান্ত আপন ভানুদাদা। কবির চিন ভ্রমণের সময় তাঁর অগোচরে রাণুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।রাণু আজ স্যার রাজেন মুখার্জির পুত্র বীরেনের ঘরণী।দুটি সন্তানের জননী।কবি আজ বৃদ্ধ। কী পেলেন তিনি রাণুর কাছ থেকে জীবনের পড়ন্তবেলায়! সে কি শুধু ‘চোখের জলে দুখের শোভা’? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে এক অভিনব ও তুলনাহীন উপন্যাস।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।