"প্রথম আলো - ১" বইয়ের ফ্ল্যাপের অংশ থেকে নেয়া: এই বিশাল, বর্ণাঢ্য, বেগবান ঐতিহাসিক উপন্যাসের পটভূমিকায় রয়েছে গত শতাব্দীর শেষ এবং বর্তমান শতাব্দীর শুরুর এক নবজাগরণের সময়কাল। সেই সময়-যখন হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে কিছু মানুষ আবিষ্কার করছে দেশ নামের এক ভাবসত্তাকে। শরীরে অনুভব করছে পরাধীনতার জ্বালা। ব্যক্তিগত মর্মযাতনা, ভালবাসার অপূর্ণতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে জাতিগত অধঃপতনের গ্লানি। দু-পর্বে বিন্যস্ত এই মহান উপন্যাসের কাহিনীর শুরু এক রাজ-অন্তঃপুরে। ঠিক যেন রূপকথার এক রাজবাড়ি, যেখানে কয়েকজন মহারাণীর সঙ্গে বিহার করছেন এক কঠোরকোমল মহারাজ, রাজপুত্র-রাজকন্যারা ঘােরাঘুরি করছে কাছাকাছি। অথচ এ কাহিনী রূপকথা নয়। মাত্র একশাে বছর আগেকার কথা এবং এই মহারাজের মুখের ভাষা বাংলা, রাজ্যের নাম-ত্রিপুরা। সেই পার্বত্য ত্রিপুরা-রাজ্য থেকে ক্রমশ এই কাহিনী বিস্তৃত হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী বাংলায়, তারপর সমগ্র ভারতে। অসংখ্য জীবন্ত চরিত্র। এঁদের মধ্যে রয়েছেন মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য, রাধাকিশাের মাণিক্য, বিলেত-প্রত্যাগত তরুণ কবি রবীন্দ্রনাথ, অকস্মাৎ-দৃষ্ট উল্কার মতন ব্যতিক্রমী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ, আধুনিক ভারতের প্রথম বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র, আয়ার্ল্যান্ডের অগ্নিকন্যা মার্গারেট নােবল, বঙ্কিমচন্দ্র, তিলক, ওকাকুরা, অবনীন্দ্রনাথ, গিরিশ ঘােষ, অর্ধেন্দু মুস্তাফি প্রমুখ বিস্তর চেনা এবং সেই সঙ্গে অনেক দরিদ্র-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ। সব ছাপিয়ে, এই উপন্যাসেরও মূল নায়ক-সময়। তীর সামনে ছুটে যাবার আগে কিছুটা পিছিয়ে যায়। বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবার পথে যে কোনও সমাজের মাঝেমাঝে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের দিকে পিছু ফিরে দেখা দরকার। আমাদের দেশের অনতি-অতীতের পুনদর্শন ও পুনর্বিচার নিয়েই প্রথম আলাে'।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।