"কসবি" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: কৈবর্তদের নিয়ে ‘জলপুত্র’ আর ‘দহনকাল’ লিখার পর। হরিশংকর জলদাস ‘কসবি’ লিখলেন। ‘কসবি’ মানে পতিতা, চলতি কথায় বেশ্যা। 'বৈদিক যুগেই বেশ্যাবৃত্তির সূচনা। রামায়ণ আর ‘মহাভারতের কাল অতিক্রম করে আজ অবধি বারাঙ্গনাবৃত্তি ভারতবর্ষজুড়ে অব্যাহত। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। সাহেবপাড়া—একটি পতিতাপল্লি। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম শহরে এর অবস্থান প্রায় তিনশ বছরের পুরনাে এই সাহেবপাড়াকে পটভূমি করে হরিশংকর জলদাস ‘কসবি’ উপন্যাসটি লিখেছেন। কসবিরা ভদ্রসমাজে বড় নিন্দাহঁ আবার বড় আকর্ষণীয়ও। ভদ্রমানুষরা দিনের বেলায় তাদের নিন্দায় মুখর কিন্তু রাতের আঁধারে তাদের সান্নিধ্যে থর থর। ভদ্রলােকদের বৈপরীত্যময় এই চারিত্র্যকে লেখক। ‘কসবি’তে উপস্থাপন করেছেন। ‘কসবি’তে রূপায়িত হয়েছে গণিকাদের রক্তপুঁজময়। অপ্রাপ্তির ইতিহাস। চম্পা, বনানী, মমতাজ মার্গারেট উমা প্র প্রভৃতি গণিকা ক্লেদময় জীবন যাপন করতে করতেই স্বাধিকার সচেতন হয়ে ওঠে কৈলাস নামের তরুণটি। তাদেরকে আনন্দময় জীবনের স্বপ্ন দেখায় তার। প্রণােদনাতেই সাহেবপাড়ায় শ্রেণিসংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু জীবন দিয়ে তার শােধ দিতে হয় কৈলাসকে। মােহিনী মাসি আর কালু সর্দারের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। গণিকা দেবযানী কৈলাসের সমার্থক হয়ে ওঠে। হিংসা-প্রতিহিংসা উপন্যাসের কাহিনীকে পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। বিচিত্র এবং স্বতন্ত্র একটি ভাষা ‘কসবি’র প্রাণ। এই উপন্যাসে সংলাপ তির্যক, তিক্ত, বিষাদময় আবার মাদকতাপূর্ণও। হরিশংকর জলদাসের ভাষার গুণে মাসিদালাল-মাস্তান-সর্দার-কাস্টমার আর কসবিরা জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে। পাঠককে আত্মজিজ্ঞাসার জগতে ঠেলে দেওয়ার জন্যই হরিশংকর জলদাস উপন্যাস লিখেন। কসবি’র কাহিনী আপনাকে ভাবাবে, সমাজজিজ্ঞাসু করে তুলবে।
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস ১৯৫৫ সালের ১২ই অক্টোবর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের উত্তর পতেঙ্গা গ্রামের এক জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা যুধিষ্ঠির জলদাস পেশায় ছিলেন একজন জেলে। ফলে আর্থিক অভাব অনটন আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনই ছিল হরিশংকরের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। হরিশংকর জলদাসের শৈশব-কৈশোর কাটে পতেঙ্গার কৈবর্তপাড়ায়। তার বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে জেলের জীবনযুদ্ধে না জড়িয়ে শিক্ষিত করবেন যেন ছেলে সম্মানের জীবনযাপন করতে পারে। হরিশংকরের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় দেবেন্দ্রলাল দে’র আদাবস্যার নামের এক পাঠশালায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে তিনি ভর্তি হন পতেঙ্গা বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৭১ সালে পতেঙ্গা হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে বাবার স্বপ্ন পূরণে আরো একধাপ এগিয়ে যান হরিশংকর। 'জাইল্যা' ঘরের সন্তান বলে তাকে বিভিন্ন সময়ে অপমানিত হতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে ‘জাওলার ছাওয়াল’ কটুক্তি। সেই কথার উচিত জবাব দিতে তিনি ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ‘নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস ও কৈবর্ত জনজীবন’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানে তিনি জেলেদের জীবনের সকল আনন্দ-বেদনা, উৎপত্তি-বিকাশ, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ইত্যাদি তুলে ধরেন। পেশাগত জীবনে হরিশংকর জলদাস চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। কিন্তু কর্মজীবনের শুরুতে অভাবের দিনগুলোতে তিনি দিনে শিক্ষকতা এবং রাতে বাবার সাথে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন। ৪৭ বছর বয়সে তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘জলপুত্র’ লেখেন। এরপর, ক্রমাগত বাজারে আসতে থাকে হরিশংকর জলদাসের নতুন বই। হরিশংকর জলদাসের বইগুলোতে সবসময়ই উঠে এসেছে নিপীড়িত, প্রান্তিক এবং নিচুতলার মানুষের কথা। হরিশংকর জলদাসের উপন্যাসসমগ্র সমৃদ্ধ হয়েছে ‘আমি মৃণালিনী নই’, ‘হৃদয়নদী, ‘রামগোলাম’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ইত্যাদি চমৎকার উপন্যাসের মাধ্যমে। হরিশংকর জলদাসের ছোটগল্প ‘লুচ্চা’, ‘জলদাসীর গল্প’, ‘মাকাল লতা’ প্রভৃতিও পাঠকপ্রিয়। এছাড়া দুটি আত্মজীবনী রচনা করেছেন তিনি। ‘কসবি’, ‘দহনকাল’, ‘জলপুত্র’ হরিশংকর জলদাস এর সেরা বই। মধ্যবয়সে লেখা শুরু করলেও সাহিত্যকর্মে নতুন মাত্রা যোগ করায় তিনি বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০১১ সালে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার’ (দহনকাল), ২০১৩ সালে ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ (জলপুত্র), ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার’ (প্রতিদ্বন্দ্বী), ‘বাংলা অ্যাকাডেমি পুরষ্কার’, ‘সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার’ সহ ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তিনি পেয়েছেন ‘একুশে পদক’।
একদম বাস্তব কিছু তুলে চিত্রিত হয়েছে। হরিশংকর জলদাসের লিখনীতে কি যে-নো আছে! একবার পড়া শুরু করলেই নেশা ধরে যায়।
Read More
Was this review helpful to you?
By Salman Mahadi,
08 Dec 2019
Verified Purchase
বইঃ কসবি লেখকঃ হরিশংকর জলদাস . রাতের পরী,বেশ্যা,কসবি,দেহাপসারিনী,পতিতা,বরাঙ্গনা-যে নামেই ডাকা হোক না কেন গালি দেওয়া ছাড়া আমাদের সমাজে শব্দগুলি নিষিদ্ধ,শব্দগুলি অশ্লীল,দূষিত করে পরিবেশ । মানুষগুলো কখনো মানুষের মর্যাদা পায় না,রাতের অন্ধকারে তারা শুধু পরিনত এক-টুকরো লোভনীয় মাংস – এছাড়া সভ্য সমাজ তাদের উপস্থিতি ভুলে থাকতে চায়-অস্বীকার করতে চায় এমনভাবে যেন তাদের অস্থিত্ব কখনো ছিল না । তারপরও তথাকতিত সভ্যসমাজের কেউ কেউ তাদের নিয়ে ভাবে,চিন্তা করে । কেউ হয়তো নতুন গল্পের জন্য, কেউ বা সত্যিকারের ভালোবাসায় ,পরম মমতায় তাদের জীবনযাত্রা-দুঃখ-কষ্ট-স্বপ্ন-হতাশাগুলোকে লিপিবদ্ধ করে ছাপার অক্ষরে । আমরা সেগুলো পড়ে হা হুতাশ করি,হাসি-কাদি তারপর ভুলে যাই । . কসবি পড়ার আগে পাওলো কোয়েলহো’র ইলেভেন মিনিটস-এ পড়েছিলাম এক ব্রাজিলিয়ান পতিতার কথা । দেহ বিকানোতে মিল থাকলেও সামাজিক,অর্থনৈতিক কারনে আমাদের দেশের পতিতাদের থেকে ‘ইলেভেন মিনিটস’ এর পতিতাদের পার্থক্য সহজেই পরিলক্ষিত হচ্ছিল । বিবিসি বা আল জাজিরার দৌলতদিয়া নিয়ে একটা ডকুমেন্টারিতে দেখেছিলাম একজন পতিতাকে দেখানো হয়েছিল যে বর্তমানে বুড়ো হয়ে গেছে । তার মেয়ের পতিতাবৃত্তির টাকায় সংসার চলছে । তাকে কিছু বলার জন্য মাইক্রোফোন দেওয়া হলে কান্না শুরু করেন । কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন,” বাবা,আমি পুরা কুরান পড়তে পারি । আয়তুল কুরসি মুহস্থ পারি । এরপরও আল্লা আমার কপালে ,আমার মেয়ের কপালে এগুলা রাখছে “ এই মহিলা উনার পুরো জীবন অনিচ্ছুক থাকার পরও পতিতাবৃত্তি করে কাটিয়েছেন,উনার সন্তানও হয়তো তাই করবে । সারা জীবন তথাকথিত ভদ্রসমাজের স্বপ্ন দেখেছেন,পূরণ হয়নি । উনার মেয়ে হয়তো এরকম স্বপ্ন দেখছে,সেটাও হয়তো পূরণ হবে না । এরকম বাধ্য হয়ে পতিতাবৃত্তিতে নাম লেখানো, স্বপ্ন দেখা , স্বপ্ন ভাঙ্গা , তাদের হাসি কান্নার গল্প উঠে এসেছে হরিশংকর জলদাসের কসবি উপন্যাসে । কসবি’র গল্প গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ পতিতাপল্লি সাহেবপাড়ার গল্প নিয়ে । তিনশো বছর ধরে চলে আসা পতিতা পল্লির উৎপত্তি,বর্তমান পতিতাদের গল্প তুলে ধরেছেন । চম্পা ,বনানী,দেবযানী,মমতাজদের ‘আর দশটা’ মেয়ে থেকে পতিতা হওয়ার গল্প তুলে ধরেছেন । সেখানে শোষনকারী কালু সর্দার,শৈলবালা,মঞ্জুমাসিদের শোষণের চিত্র তুলে ধরেছেন । সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সমাজসংস্কার করতে চাওয়া কৈলাসের পরিনতি দেখিয়েছেন । বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে না গিয়ে তথাকথিত সভ্য সমাজ যাদের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না তাদেরকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন কিছুটা মুক্তির-স্বাধীনতার-সাম্যের । . হরিশংকর জলদাস বর্তমানে সময়ের জনপ্রিয়-পাঠকপ্রিয় কথাসাহিত্যিক । পিএইচডির থিসিস লিখতে গিয়ে উপন্যাস লেখা শুরু । বাংলাদেশের সমসাময়িকদের লেখায় জেলে,নাপিত,বেশ্যা,ব্যাধ,ধোপা স্থান পেতে না দেখে নিজেই তাদের জীবন নিয়ে লিখতে শুরু করেন । তৈরি করে নিয়েছেন নিজস্ব গল্প বলার ভঙ্গি , পেয়েছেন জনপ্রিয়তা-পুরষ্কার সবই । ব্যক্তিগতভাবে তার লেখনি সম্পর্কে ভালো লাগা শুরু হয় ‘আমি মৃণালিনী নই’ পড়ে । কসবিও অসাধারন লেগেছে । হরিশংকর জলদাসের লেখা পড়ে না থাকলে ‘কসবি’ দিয়ে শুরু করতে পারেন ,লেখক সম্পর্কে ভালো লাগা স্থায়ী হয়ে যাবে ।
Read More
Was this review helpful to you?
By Arman Hossian,
26 Dec 2019
Verified Purchase
"কসবি" মানে পতিতা, চলতি কথায় বেশ্যা। বৈদিক যুগেই বেশ্যাবৃত্তির সূচনা।' রামায়ন' আর ' মহাভারতের' কাল অতিক্রম করে আজ অবধি বারাঙ্গনাবৃত্তি ভারতবর্ষজুড়ে অব্যাহত। বাংলাদেশও তার ব্যাতিক্রম নয়। সাহেবপাড়া —একটি পতিতাপল্লী, বাংলাদেশের চট্রগ্রাম শহরে এর অবস্থান। প্রায় তিনশ বছরের পুরনো এই সাহেবপাড়াকে পটভূমি করে হরিশংকর জলদাস "কসবি" উপন্যাসটি লিখেছেন।
কসবিরা ভদ্রসমাজে বড় নিন্দার্হ আবার বড় আকর্ষণীয়ও। ভদ্রমানুষরা দিনের বেলায় তাদের নিন্দায় মুখর আর রাতের আধারে তাদের সান্নিধ্যে থর থর। ভদ্রলোকদের বৈপরীত্য ময় এই চারিত্র্যকে লেখক "কসবি" তে উপস্থাপন করেছেন।
"কসবি" তে রূপায়িত হয়েছে গণিকাদের রক্তপুজময় অপ্রাপ্তির ইতিহাস। চম্পা, বনানী, মমতাজ, মার্গারেট, উমা প্রু প্রভৃতি গণিকা দের জীবন যাপন করতে করতেই স্বাধিকার সচেতন হয়ে ওঠে।কৈলাস নামের তরুণটি তাদেরকে আনন্দময় জীবনের স্বপ্ন দেখায়।তার প্রণোদনাতেই সাহেবপাড়ায় শ্রেণীসংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু জীবন দিয়ে তার শোধ দিতে হয় কৈলাসকে।
মোহিনী মাসি আর কালু সর্দারের বিরোধ প্রকট হয়ে ওঠে। গণিকা দেবযানী কৈলাসের সমার্থক হয়ে ওঠে। হিংসা—প্রতিহিংসা উপন্যাসের কাহিনীকে পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যায়।
বিচিত্র এবং স্বাধীন একটি ভাষা "কসবির" প্রাণ এই উপন্যাসে সংলাপ তির্যক, তিক্ত, বিষাদময় আবার মাদকতাপূর্ণও। হরিশংকর জলদাসের ভাষার গুণে মাসি ,দালাল, সন্ত্রাস , সর্দার ,কাস্টমার আর কসবিরা জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে।
কাহিনী এবং সমাজ—দুটোকে একসঙ্গে জানতে চান যাঁরা, তাঁদের জন্যেই ‘কসবি’। ‘কসবি’ বেশ্যাদের জীবনিতিহাস। এই ইতিহাস—বড় ক্লেদাক্ত, বড় রিরংসা জাগানিয়া।