"একলব্য" একলব্য। অনার্য। প্রান্তজন। 'মহাভারতের অবহেলিত চরিত্র । অপাঙক্তেয় বলে দুর্দমনীয় । দ্রোণাচার্যের ঘৃণা-চাতুর্য আর সতীর্থ অর্জনের হিংস্রতা নিষাদ একলব্যকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যায় । কিন্তু হিরণ্যধনুপুত্র একলব্য এসব বিধ্বংসী বিরােধিতাকে অতিক্রম করে নিজস্ব পথ ও জগৎ তৈরি করে নেয় । অর্জন আচার্য দ্রোণের প্রিয়তম শিষ্য। অর্জনের প্ররােচনায় শিষ্যত্বপ্রত্যাশী একলব্যের ডানহাতের বুড়ো আঙুল কেটে নেন দ্রোণাচার্য তীর-নিক্ষেপণে ডানহাতের বুড়াে আঙুলটি অপরিহার্য। ‘গুরু' না হয়েও গুরুদক্ষিণা' নিলেন দ্রোণ । একলব্যের অপরাধ সে স্বচেষ্টায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী ধনুর্ধর হয়ে উঠেছে। ঘটনা পরম্পরায় প্রিয়তম শিষ্য অর্জুন গুরুদেব দ্রোণের ঘােরতর শক্রতে রূপান্তরিত হয়েছে। গুরুকে হত্যা করতে উদ্যত অর্জন, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে একদার অস্পৃশ্য-অবহেলার একলব্য দ্রোণাচার্যকে আড়াল করে অর্জুনের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় । একলব্য কি তার মানস-গুরুকে অর্জুনের হাত থেকে বাচাতে পারে ? আর্যশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে শেষাবধি অনার্যরা কি টিকে থাকতে পারে ? স্বাজাত্যাভিমানী একলব্য শেষ পর্যন্ত ক্ষত্রিয়ানুরাগী কৃষ্ণকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে প্রাকৃত মানুষের অধিকার কি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে ? এসব প্রশ্নের উত্তর আছে হরিশংকর জলদাসের 'একলব্য' নামের এই এপিকধর্মী উপন্যাসে। হরিশংকর কাহিনি লেখার সঙ্গে সঙ্গে সমাজকেও আঁকেন আর্যসমাজব্যবস্থার পাশাপাশি ব্রাত্যমানুষদের জীবনও সুনিপুণভাবে এঁকেছেন লেখক, এই উপন্যাসে । 'একলব্যের ভাষা অভিজাত। মহাভারতের মতােই একলব্যের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় কাহিনির মােচড়। উল্লাস-রিরংসা, রাজ্যলােভহাহাকার, জ্ঞাতিশত্রুতা-হিংস্রতা—এই উপন্যাসের পরতে পরতে আশা—'একলব্য' উপন্যাসটি পাঠকের তুা মিটাবে, হরিশংকর জলদাসের অন্যান্য উপন্যাসের মতােই।
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস ১৯৫৫ সালের ১২ই অক্টোবর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের উত্তর পতেঙ্গা গ্রামের এক জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা যুধিষ্ঠির জলদাস পেশায় ছিলেন একজন জেলে। ফলে আর্থিক অভাব অনটন আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনই ছিল হরিশংকরের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। হরিশংকর জলদাসের শৈশব-কৈশোর কাটে পতেঙ্গার কৈবর্তপাড়ায়। তার বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে জেলের জীবনযুদ্ধে না জড়িয়ে শিক্ষিত করবেন যেন ছেলে সম্মানের জীবনযাপন করতে পারে। হরিশংকরের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় দেবেন্দ্রলাল দে’র আদাবস্যার নামের এক পাঠশালায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে তিনি ভর্তি হন পতেঙ্গা বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৭১ সালে পতেঙ্গা হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে বাবার স্বপ্ন পূরণে আরো একধাপ এগিয়ে যান হরিশংকর। 'জাইল্যা' ঘরের সন্তান বলে তাকে বিভিন্ন সময়ে অপমানিত হতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে ‘জাওলার ছাওয়াল’ কটুক্তি। সেই কথার উচিত জবাব দিতে তিনি ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ‘নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস ও কৈবর্ত জনজীবন’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানে তিনি জেলেদের জীবনের সকল আনন্দ-বেদনা, উৎপত্তি-বিকাশ, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ইত্যাদি তুলে ধরেন। পেশাগত জীবনে হরিশংকর জলদাস চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। কিন্তু কর্মজীবনের শুরুতে অভাবের দিনগুলোতে তিনি দিনে শিক্ষকতা এবং রাতে বাবার সাথে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন। ৪৭ বছর বয়সে তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘জলপুত্র’ লেখেন। এরপর, ক্রমাগত বাজারে আসতে থাকে হরিশংকর জলদাসের নতুন বই। হরিশংকর জলদাসের বইগুলোতে সবসময়ই উঠে এসেছে নিপীড়িত, প্রান্তিক এবং নিচুতলার মানুষের কথা। হরিশংকর জলদাসের উপন্যাসসমগ্র সমৃদ্ধ হয়েছে ‘আমি মৃণালিনী নই’, ‘হৃদয়নদী, ‘রামগোলাম’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ইত্যাদি চমৎকার উপন্যাসের মাধ্যমে। হরিশংকর জলদাসের ছোটগল্প ‘লুচ্চা’, ‘জলদাসীর গল্প’, ‘মাকাল লতা’ প্রভৃতিও পাঠকপ্রিয়। এছাড়া দুটি আত্মজীবনী রচনা করেছেন তিনি। ‘কসবি’, ‘দহনকাল’, ‘জলপুত্র’ হরিশংকর জলদাস এর সেরা বই। মধ্যবয়সে লেখা শুরু করলেও সাহিত্যকর্মে নতুন মাত্রা যোগ করায় তিনি বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০১১ সালে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার’ (দহনকাল), ২০১৩ সালে ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ (জলপুত্র), ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার’ (প্রতিদ্বন্দ্বী), ‘বাংলা অ্যাকাডেমি পুরষ্কার’, ‘সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার’ সহ ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তিনি পেয়েছেন ‘একুশে পদক’।