প্রচারবিমুখ ও বহুমাত্রিক লেখক মোজাম্মেল হক নিয়োগী বিভিন্ন বিষয়ে লিখেছেন শতাধিক গ্রন্থ। অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত সাদাসিদে মানুষ, নিবেদিত এই লেখক নিভৃতেই আপন মনে লিখে যাচ্ছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, যতটা সম্ভব এড়িয়ে যান মঞ্চ বা ক্যামেরা। যার ফলে সাহিত্যের এতো বড় সম্ভার সৃষ্টি হওয়ার পরেও পাঠকের দৃষ্টির অগোচরেই রয়ে যাচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি শেষ করলাম মোজাম্মেল হক নিয়োগীর ‘শেষ কথাটি যাও বলে’ নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটি। উপন্যাসটির পাঠান্তে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী কবিতার’ অনুধ্বনি-প্রতিধ্বনি বুকের ভিতরে গুঞ্জন তোলে। ‘হাসিটুকু, কথাটুকু,/নয়নের দৃষ্টিটুকু,/প্রেমের আভাস/... লও তার মধুর সৌরভ,/দেখো তার সৌন্দর্যবিকাশ,/মধু তার করো তুমি পান,/ভালোবাসো,/প্রেমে হও বলী,/চেয়ো না তাহারে।’ প্রেমাস্পদকে কাছে না পেয়ে দূর থেকে ভালোবাসার নিগূড় উত্তাপ প্রেমকে উসকে দেয়, অঙ্কুরিত হতে থাকে প্রেমের মহীরূহ। নিষ্কাম প্রেমের মিঠেল অনুভূতি উপন্যাসের প্রতিটি পৃষ্ঠায়, প্রতিটি লাইনে বিধৃত। আলোচ্য উপন্যাসেও প্রেমিক-প্রেমিকার শরীরের আরাধনা নেই, উভয়ের মনস্কামনা লীন হয় ত্রিভুজ অথচ গভীর প্রেমের মহিমায়। আখ্যানটিকে একটি ভ্রমণকাহিনির দলিলও বলা যায়। ভ্রমণকাহিনির উর্বর মৃত্তিকায় ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হতে থাকে রোমান্টিক প্রেমের বৃক্ষটি। লেখক উপন্যাসের এই কাহিনিতে জলো প্রেমের কাছাকাছি গিয়েও শিল্পিতভাবে অনন্য পরিমিত বোধের পরিচয় দিয়েছেন, এই পরিমিতি বোধ পাঠকের মনে অকৃত্রিম প্রেমের রস সঞ্চার করে নিয়ে যাবে ভাবনার অন্তহীন জগতে। অপরিমিত বোধই এই উপন্যাসটিকে উচ্চমানের সাহিত্যশিল্পের পর্যায়ে নিয়েছে। গল্পের নায়ক নির্ঝর একটি ওষুধ কোম্পানির ভালো কর্মকর্তা হিসেবে আরও পাঁচজন শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে ভারতে যায় একটি প্রণোদনা প্রশিক্ষণে অংশ নিতে। এই দলে সুহানা নামে এক অপূর্ব সুন্দরী তরুণী ছিল। নির্ঝর আর সুহানা বাসের পাশাপাশি সীটে বসে দীর্ঘ পথ পরিভ্রমণের মধ্যে উভয়েই রোমাঞ্চিত হয়, সুহানার মধুরললিত শিল্পময় কথায় নির্ঝর যখন মনে মনে নিজেকে সমর্পণ করার প্রস্তুতি নিতে থাকে তখনই সুহানার চাতুরী অভিনয় ধরা পড়ে, প্রচ- ধাক্কা খায় নির্ঝর, আর সে ধাক্কার স্ফুলিঙ্গ বুকের গভীরে দাবদাহের সৃষ্টি হয়। অন্তর্দহনে দগ্ধ হওয়ার সময়ই এক সময় তাদের ভ্রমণ গাইড একহারা মিষ্টি চেহারার অধরার সঙ্গে পরিচয় এবং কয়েক দিন একই সঙ্গে থাকার ফলে পারস্পরিক ভালো লাগা শুরু হয় নির্ঝরের। নির্ঝর আর অধরার ভালো লাগাটা সুহানা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না বটে, তবে সে কিছুই করতে পারে না। অধরার সঙ্গে ছুটির দিনেও ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন স্থানে এবং একদিন বেড়াতে গিয়ে ঝড়ের কবলে পড়ে একটি হোটেলে আশ্রয় নেয় ওরা। একই বিছানায় দুজন ঘুমায়। কিন্তু একই বিছানায় ঘুমালেও লেখক এই তরুণ-তরুণীকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন এবং গল্পের বাঁক ঘুরিয়ে দিয়েছেন যেখানে পাঠক থমকে দাঁড়াতে বাধ্য। কারণ এতো গভীর রোমান্টিক মুহূর্তেও নির্ঝর আর অধরা নিজেদের সংযত রাখে; শরীরের উত্তাপকে গুরুত্ব না দিয়ে নিষ্কাম প্রেমের একটি বিরল অধ্যায় রচনা করে। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতার’ মতো একটি ধ্বনি যেন শুনতে পাওয়া যায়, “For the God’s sake, hold your tongue and let me love!” নির্ঝর বা অধরা কারো কাছেই শরীর কাক্সিক্ষত হয়ে ওঠেনি বরং নিগূড় মনস্কামনায় ভালোবাসার বাতাবরণে উভয়ে প্রেমকেই বড় করে দেখেছে। উপন্যাসের কাহিনি বিন্যাস, রচনা শৈলী, বর্ণনার ধরন এতোটাই বাস্তবধর্মী করা হয়েছে যে, পাঠক নিশ্চয়ই ভাববেন এটি লেখকের জীবনেরই ঘটনা। এর কারণ হলো, ভ্রমণের বিস্তারিত বৃত্তান্ত পাঠে এমন ধারণা হওয়াটা খুব স্বাভাবিক। ভারতবর্ষের অনেক স্থাপত্য, পথ, হোটেল, মানুষের আচার-আচরণ, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ের জীবন্ত বর্ণনা মুগ্ধ করে। উপন্যাসের কয়েকটি স্থানে ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ দিয়ে ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দিয়ে লেখক যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত অধরাকে লেখক নোম্যান্স ল্যান্ডে আকস্মিক ও নাটকীয়ভাবে এনে দুজনকে নিবিড় ও অত্যন্ত কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে লেখক উপন্যাসটিকে শেষ করেছেন। কী কথা হবে শেষ কথা? কেই বা বলে যাবে শেষ কথাটি? এই দৃশ্যকল্পে পাঠকের মনে নানা রকম প্রশ্নই জাগতে পারে যার মীমাংসা পাঠককেই করতে হবে। আরও উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে ইংরেজি ও বাংলা কবিতার উদ্ধৃত্তি। দীর্ঘদিনের একনিষ্ঠ হোমওয়ার্ক ছাড়া এমন উপন্যাসের কাঠামো নির্মাণ করা অসম্ভব। নিষ্ঠা ও হোমওয়ার্কের কৃতিত্ব লেখক নিয়োগীকে দিতে হয়, এই সম্মান ও স্বীকৃতি তাঁর প্রাপ্য। উপন্যাসটি ঝরঝরে ভাষায় লেখা এবং এক বৈঠকে পড়ে শেষ করতে পারলেও এর রেশ থেকে যায় দীর্ঘদিন। সুহানা, নির্ঝর ও অধরাকে বুকের গভীরে স্থান না দিয়ে উপায় নেই। একটি উপন্যাসে যেমন উত্থান-পতন ক্লাইমেক্স থাকে এই উপন্যাসেও এসব বিষয় নিপুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। পাঠককে ভালো লাগার আচ্ছন্নতায় ডুবিয়ে রাখে সন্দেহাতীতভাবে। অফসেট কাগজে ছাপা, দৃষ্টিকাড়া প্রচ্ছদের জ্যাকেটি চমৎকার বোর্ড বাঁধাই ‘শেষ কথাটি যাও বলে’ নাতিদীর্ঘ অথচ মূল্যবান উপন্যাসটির পাঠকপ্রিয়তা ও সাফল্য কামনা করি। সঙ্গীতা ইয়াসমিন কবি ও প্রাবন্ধিক কানাডা প্রবাসী
মােজাম্মেল হক নিয়ােগী। ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সুরাশ্রম গ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বাবা ফজলুল হক নিয়ােগী বিমান বাহিনীর সৈনিক ছিলেন। মা সুফিয়া বেগম ছিলেন গৃহিনী। ছয় ভাই-বােনের মধ্যে তৃতীয়। শতাধিক বইয়ের রচয়িতা কঠোর পরিশ্রমী লেখক। স্বভাবে কোণঘেঁষা। নিভৃতচারী। বহুমাত্রিক লেখক। লেখার বিষয়ও বহুমাত্রিক: জীবনবােধ, লােকজ সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষাআন্দোলন, বাস্তবতা, পরাবাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। প্রান্তিকী, জলের লিখন, ফাঁদ, কালবাতাস, কুহেলীকুহক, ঘূর্ণিবায়ু ও ধূসর কাবিন, ছায়াপথ, অরণি, অ্যাকোরিয়ামের মীনকন্যা, শেষ কথাটি যাও বলে ইত্যাদি উপন্যাস সমাজবাস্তবতার জীবন্ত দলিল। সত্তরের অধিক শিশুসাহিত্যের বই। বত্রিশের সবুজ পাতা, শরণার্থী শিবির থেকে, আগুনঝরা দিনগুলাে, রাজুদের বাড়ি আসার পর, ছােট মামা উল্লেখযােগ্য কিশাের-কিশােরী উপন্যাস। চৌদ্দটি গানের সুরমঞ্জরিত হয়েছে। কৃষ্ণপক্ষের জোছনা ও ‘গন্তব্য' নামে দুটি শর্ট ফিল্ম নির্মাণ করেছেন। প্রশিক্ষণ ও গবেষণা বিষয়ক একাডেমিক বই আটটি এবং এগুলাের মধ্যে দুটি বই কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স বই। ইংরেজি ভাষাতে লেখা ও অনূদিত বই রয়েছে কয়েকটি। তিন বিষয়ে স্নাতকোত্তর (সমাজকল্যাণ, রাষ্ট্র বিজ্ঞান ও শিক্ষা)। চাকরি করেছেন সিসিডিবি, আইসিডিডিআর,বি, কেয়ার বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউনেস্কোসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে ব্রিটিশ কাউন্সিলে কর্মরত।