৬৯টি কবিতায় কবি যা বলতে চেয়েছেন, এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে গদ্যাকারে তা প্রকাশের প্রয়াস নেহাত সহজ নয়। জীবন সম্পর্কে কবির ধারণা, উপলব্ধি একান্ত নিজস্ব, আপন ছায়ায় ঘেরা। চারপাশের পরিবর্তন কবির কাছে এক অপার বিস্ময়। এই পরিবর্তন কবির ভাবনার দেয়ালে কখনো ফুলের টোকা দেয়, কখনো কুঠারাঘাত করে। কবি বিচলিত হন না, থেমে যান না। কখনো পাড়ি দেন ঢেউয়ের সাগরে। অপেক্ষা করেন জোয়ারের। কাঁপা হাতে দাঁড় টেনে আবার তীরে ভেড়ান তরী। মানবজীবনে সম্পর্ক একটা জটিল বিষয়। সম্পর্কের পরিধি, চৌহদ্দি কবির মনোজগতের প্রিয় বিষয়গুলোর একটি। তাই তো কবির কলমের ডগায় অলক্ষ্যে চলে আসে, ‘কাগজ মেয়াদোত্তীর্ণ হলে/ চেনা বন্ধুকে হঠাৎ অচেনা লাগে/ সে আসে ভিজিটর বেশে/ তবু সে হাসে, অনেক দিনের চেনাজানা তো।’ কখনো যাপিত জীবনে হাঁপিয়ে ওঠেন কবি। সবকিছু বিরক্ত লাগে। নগরজীবনের এ বিরাট সমস্যা। এ জীবনে মনের খেয়ালের দাম নিতান্তই গৌণ। উদরপূর্তি, সুপরিচ্ছদ, গাড়ি-পার্টি, স্ট্যাটাসই যেন সব। এই চক্রাকার জীবন থেকে একটু বিরতি চান কবি। ভিড় ঠেলে বসতে চান দূরে গিয়ে। কখনো কখনো কবি তাকাতে চান খোলা জানালায়, যেখানে রোদে দেওয়া ঘুঁটে কুড়িয়ে নেয় মোল্লাবাড়ির পোয়াতি বউ, যেখানে স্কুলের সমাপনী ঘণ্টা বাজলে শিশুরা দৌড়ে ঘরে ফেরে। এ আকর্ষণ থেকে নিজস্ব বাড়ির বাসিন্দা হয়ে জীবন কাটানো কবির কাছে বেশি সুখপ্রদ। চারপাশের শঠতা, মিথ্যা, প্রবঞ্চনা কবিকে ভীষণ পীড়া দেয়। কবির কবিতারা তাই সশস্ত্র বিক্ষোভে নামে। ‘স্যুট পরে মাইকে বক্তৃতা দেয় দাঁতালেরা/ ঘোঁৎঘোঁৎ আওয়াজে, থলথলে মাংসের শরীরে/ সে বক্তৃতা লাইভ সম্প্রচার হয়/ সুন্দরী প্রেজেন্টারের রোবট হাসিতে।’ প্রেম নানা বর্ণে-ছন্দে এই কাব্যগ্রন্থের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা জুড়ে আছে। কবি তাঁর প্রিয় মানুষদের হারিয়ে খোঁজেন। কবি যখন ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রেমপত্র লিখতে যান, তখনই শব্দেরা সপ্তাহ খানেকের ছুটি চেয়ে আবেদন করে বসে। কবিকে থাকতে হয় অপেক্ষায়! ভাঙা কাঠের সেতু কাজী আলিম-উজ-জামানের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের বেশ কিছু কবিতা প্রকাশিত হয়েছে দেশের প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকগুলোর সাহিত্য সাময়িকীতে, নন্দিত সাময়িকপত্রগুলোতে। আর বেশ কিছু কবিতা নিরাভরণ শরীর নিয়ে হাজির হয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে। কাজী আলিম-উজ-জামানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ জোছনার মেয়ে বৃষ্টির বোন-এর শুভাগমন ঘটেছিল ২০১৫ সালের একুশে গ্রন্থমেলায়। কবিতা যাঁরা ভালোবাসেন, যাঁরা কাব্যের মানুষ, ভাঙা কাঠের সেতু তাঁদের নিরাশ করবে না এটুকু অন্তত আমরা বলতে পারি।
কাজী আলিম-উজ-জামান একবার এক প্রকাশক একজন ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তিনি একজন ‘জাত কবি’। শব্দ দুটি আমার চেতনায় অনুরণন তোলে। আমারও নিজেকে সাহিত্যের একজন কর্মী ভাবতে বেশ লাগে। ভাবি, সত্যিই সাহিত্য দেবী যদি এসে হাত ধরে বলত, এসো, আমার ঘরে এসো। তোমাকে দেখাবো নতুন এক পৃথিবী। তুমি এখন এই ভুবনের বাসিন্দা। আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তোমার। আমি অপেক্ষায় আছি, নিশ্চয়ই সেই দিন আসবে। কাজী আলিম-উজ-জামান। জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৭৮, বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামে। লেখাপড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত প্রায় দুই দশক। এর মধ্যে বিগত দেড় দশক কেটেছে দেশের প্রধান দৈনিক প্রথম আলোয়। এখন এই পত্রিকার সহকারী বার্তা সম্পাদক। সাহিত্যের ভাবনা কখনও কবিতা হয়ে আসে, কখনও গল্প হয়ে। বিশ্বাস করি, কবিতা ও গল্পের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তাই কখনও লিখি কবিতা, কখনও গল্প। পাশাপাশি আগ্রহ বিচিত্র বিষয়ে, বিশেষত গবেষণায়। জুন ২০১৬ থেকে প্রথম আলোয় লিখছি ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘ঢাকার পাঠাগার’, যা অদ্যাবধি চলছে (ফেব্র“য়ারি ২০১৭)। সন্ধ্যায় ফেরার সময় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থের সাতটি গল্পের মধ্যে কয়েকটি ছাপা হয়েছে দৈনিকের সাময়িকীতে। বাকিগুলো আলগা শরীর নিয়ে হাজির হয়েছে এই গ্রন্থে। প্রকাশিত গ্রন্থ: জোছনার মেয়ে বৃষ্টির বোন (কবিতা, রোদেলা প্রকাশনী ২০১৫); ভালোবাসার হরেক রং (গল্প, রোদেলা প্রকাশনী ২০১৫); ভাঙা কাঠের সেতু (কবিতা, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন ২০১৬)