কাজী আলিম-উজ-জামান কবিতায় কথা বলেন সহজিয়া ভাষায়। চড়া সুরে নয়, সান্দ্র নম্র স্বরে। নিজ স্বভাবের মতনই তাঁর কবিতার স্বরটিও অনুচ্চ, মরমি। ২০১৫ সালে বেরিয়েছিল তাঁর প্রথম কবিতাবই ‘জোছনার মেয়ে, বৃষ্টির বোন’; পরের বছর দ্বিতীয় কবিতাবই ‘ভাঙা কাঠের সেতু’। ২০২৩ সালে এসে এটি তাঁর তুতীয় কবিতাবই। সময়ের নিরিখে কবিতায় ভ্রমণ তাঁর ততটা দীর্ঘ নয়; তবে, দীর্ঘ ভবিষ্য-ভ্রমণের জন্য তিনি যে প্রস্তুত, সেটা আঁচ করা যায়- এই তিনটে বইতে। স্বভাবমরমি এই কবি ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার ধোঁয়াশা ও বিমূর্ততার অস্পষ্ট পথ এড়িয়ে ঐতিহ্যবাহিত চেনা পথ ধরে হেঁটেছেন- চারপাশের মানুষ, সমাজের নিবিড় কল্লোল আর প্রাণ-প্রকৃতিকে সঙ্গী করে। পরাবাস্তবের আবছায়া কুহকের চেয়ে তাঁর কবিতায় মুখোশহীন বাস্তবের রৌদ্রের গরিমা বেশি জ্বলে। মোদ্দাকথা, কলাকৈবল্যবাদের হর্ম্যমিনারে বসে কবিতা রচনা তাঁর ধাতে নেই; বরং তাঁর মন স্ফূর্তি পায় আটপৌরে জীবনের একতারা, দোতারা বাজিয়ে। সামান্যতে অসামান্যের ব্যঞ্জনাপ্রয়াসী তিনি। তাই ব্যক্তির বিকার ও অসংগতির পাশাপাশি সমাজের গোড়ালিতে জমে থাকা রক্ত ও পুঁজও তাঁর নজর এড়ায় না। তবে এসব অনুষঙ্গ তাঁর কবিতায় ক্লিশে আর নিরক্ত, পাঁশুটে আর নিরেট বিবৃতি আকারে উঠে আসে না। বরং তা গাঢ় অনুভূতির আঁচে সংরক্ত ও বাঙ্ময়। সস্তা করতালির লোভে মজে উচ্চকণ্ঠ উল্লাসে পাড়া-মাত-করবার ফাঁদে পা না দিয়ে তিনি হেঁটেছেন মগ্নতার মরমিপথে। এই বইটিতে তিনি ছন্দ-আঙ্গিকের ছক এড়িয়ে নির্ভার টানা গদ্যে কথা বলতে চেয়েছেন। এ-বইয়ের বেশ কিছু কবিতায় শ্লেষ বক্রোক্তি যেমন আছে, তেমনই আছে বাউলগন্ধী, গাঢ় অনুভূতিদীপিত স্বরও। কিন্তু কবিতা তো বহুস্তর উদ্ভাসও দাবি করে, দাবি করে নানা রূপান্তর- নতুন শব্দে ও ভাষায়। নব অভিপ্রায়ে আর কল্পনার অভিনবতার মায়া ও ম্যাজিকে। আমরা চাই, বহুস্তর কল্পনা ও ভাবের দেয়ালে মাথাচাড়া দিক অজস্র নতুন ফণীমনসার বসতবাড়ি। সেখানে কবিতার নতুন নতুন কাঠঠোকরা এসে শব্দে-শব্দে ভরিয়ে তুলুক কবিতার বিপুল তল্লাট। জুয়েল মাজহার
কাজী আলিম-উজ-জামান একবার এক প্রকাশক একজন ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তিনি একজন ‘জাত কবি’। শব্দ দুটি আমার চেতনায় অনুরণন তোলে। আমারও নিজেকে সাহিত্যের একজন কর্মী ভাবতে বেশ লাগে। ভাবি, সত্যিই সাহিত্য দেবী যদি এসে হাত ধরে বলত, এসো, আমার ঘরে এসো। তোমাকে দেখাবো নতুন এক পৃথিবী। তুমি এখন এই ভুবনের বাসিন্দা। আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তোমার। আমি অপেক্ষায় আছি, নিশ্চয়ই সেই দিন আসবে। কাজী আলিম-উজ-জামান। জন্ম ৮ জানুয়ারি ১৯৭৮, বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার মূলঘর গ্রামে। লেখাপড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত প্রায় দুই দশক। এর মধ্যে বিগত দেড় দশক কেটেছে দেশের প্রধান দৈনিক প্রথম আলোয়। এখন এই পত্রিকার সহকারী বার্তা সম্পাদক। সাহিত্যের ভাবনা কখনও কবিতা হয়ে আসে, কখনও গল্প হয়ে। বিশ্বাস করি, কবিতা ও গল্পের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। তাই কখনও লিখি কবিতা, কখনও গল্প। পাশাপাশি আগ্রহ বিচিত্র বিষয়ে, বিশেষত গবেষণায়। জুন ২০১৬ থেকে প্রথম আলোয় লিখছি ধারাবাহিক প্রতিবেদন ‘ঢাকার পাঠাগার’, যা অদ্যাবধি চলছে (ফেব্র“য়ারি ২০১৭)। সন্ধ্যায় ফেরার সময় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ। গ্রন্থের সাতটি গল্পের মধ্যে কয়েকটি ছাপা হয়েছে দৈনিকের সাময়িকীতে। বাকিগুলো আলগা শরীর নিয়ে হাজির হয়েছে এই গ্রন্থে। প্রকাশিত গ্রন্থ: জোছনার মেয়ে বৃষ্টির বোন (কবিতা, রোদেলা প্রকাশনী ২০১৫); ভালোবাসার হরেক রং (গল্প, রোদেলা প্রকাশনী ২০১৫); ভাঙা কাঠের সেতু (কবিতা, অ্যাডর্ন পাবলিকেশন ২০১৬)