এই বিশ্বস্রষ্টার নির্দেশে গ্রামের ছেলে সন্দীপ লাহিড়ী একদিন কলকাতা শহরে এসেছিল। তখন সে বালক। এসে এমন একটা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল যেখানে অর্থসামর্থ্য আর প্রাচুর্য্যের অপ্রতিহত স্থিতি। সেই অর্থ-সামর্থ্য আর প্রাচুর্য্যের পরিবেশ কল্পনাতীত ছিল। তখন থেকে এই শহরে চরম দারিদ্র্য দেখলে, চরম বৈরাগ্য দেখলে, ঐশ্বর্য্য দেখলে, তার সঙ্গে দেখলে প্রত্যেকটি মানুষের সঙ্গে প্রত্যেকটি মানুষের সবরকম প্রতিযোগিতা—অর্থের প্রতিযোগিতা, অনর্থের প্রতিযোগিতা, দম্ভের প্রতিযোগিতা, ক্ষমতার প্রতিযোগিতা। সব কিছু দেখে সন্দীপ ভাবলে—এ কোথায় এলাম আমি, চারপাশের এই সব কারা? অথচ তারই মতন সকলের দু'টো করে হাত আছে, দু'টো করে পা আছে, একটা করে মাথা আছে—অথচ এদেরও তো সবাই মানুষ বলে জানে, মানুষ বলে ভাবে। সে ভাবতে লাগলো তাহলে তার কী করণীয়, তার কী কর্তব্য, তার কী লক্ষ্য হওয়া উচিত? কী করলে সে মানুষ পদবাচ্য হবে? কী করলে তার মনুষ্য-জন্ম সার্থক হবে, সম্পূর্ণ হবে? সেই প্রশ্নের উত্তরই সে সারা জীবন ধরে খুঁজতে লাগলো। খুঁজতে লাগলো কোথায় তার আদি, কোথায় তার অন্ত? আদি-অন্তহীন যে অনন্ত, তার সন্ধান সে কী করে কোথায় পাবে? কার কাছ থেকে পাবে? আর সম্পূর্ণতা? সে সম্পূর্ণই বা হবে কোন পথে? যখন সে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে তখন কি সে এই জগৎ সংসারকে অন্যদের মতো কেবল বঞ্চনা করেই যাবে? মানুষের জন্যে এতটুকু সত্য, এক কণা মঙ্গলও কি সে রেখে যেতে পারবে না? সামান্য এই দেহটার পরিচর্যা করেই বেঁচে থাকবে? এই নশ্বর নরদেহটা ?
Bimal Mitra কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্রের জন্ম ১৯১২ সালের ১৮ই মার্চ। চেতনা স্কুল ও আশুতোষ কলেজে শিক্ষালাভের পর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ পাশ করেন ১৯৩৮ সালে । গোড়ায় গান লেখার শখ ছিল । বিখ্যাত গায়করা তাঁর গানে সুর দিয়েছিলেন। পরে তিনি কথাসাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম জীবনে রেল বিভাগে চাকরি করতেন। তারপর সে গল্প-উপন্যাস প্ৰবন্ধ নিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা একশতরও অধিক। বাংলা ১৩৭০ সালে তার সরকার রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কারে সংবর্ধিত করেন। এই উপন্যাসটি এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম এবং সর্বোচ্চ মূল্যবান উপন্যাস। তবে সাহিত্য পুরস্কার লাভের থেকেও বিমল মিত্র সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বঙ্গভাষার সাহিত্যিকদের মধ্যে শরৎচন্দ্রের পর তিনিই সর্বভারতীয় সাহিত্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিলেন । তিনি বেগম মেরী বিশ্বাস, সাহেব বিবি গোলাম, কড়ি দিয়ে কিনলাম, একক দশক শতক, পতি পরম গুরু, এই নরদেহ-এপিক উপন্যাসের মাধ্যমে তিনশো বছরের সমাজজীবনের এক বিস্তৃতকালের চালচিত্র বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন । ১৯৯১ সালের ২রা ডিসেম্বর তার তিরোধান হয় ।