বুদ্ধদেব বসু আধুনিক কবিতার চরিত্র নির্দেশ করতে গিয়ে তাঁর সংকলিত আধুনিক বাংলা কবিতা-র ভূমিকায় উল্লেখ করেছিলেন : একে বলা যেতে পারে বিদ্রোহের, প্রতিবাদের কবিতা, সংশয়ের, ক্লান্তির, সন্ধানের, আবার এরই মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিস্ময়ের জাগরণ, জীবনের আনন্দ, বিশ্ববিধানে আস্থাবান চিত্তবৃত্তি। আশা আর নৈরাশ্য, অন্তর্মুখিতা ও বহির্মুখিতা, সামাজিক জীবনের সংগ্রাম ও আধ্যাপক জীবনের তৃষ্ণা, এই সবগুলো ধারাই খুঁজে পাওয়া যাবে ...। এই বৈশিষ্ট্যকে অঙ্গীকার করে বাংলা কবিতার আধুনিকতার যে পালাবদল, তা হয়েছিল মূলত তিরিশের কবিদের হাত ধরে। কবিতার এই মৌলিক রূপান্তর ছিল প্রসঙ্গ ও প্রকরণ উভয় দিক থেকেই। তিরিশের প্রধান কবি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-১৯৮৭), বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) ও বিষ্ণু দে (১৯০৯-১৯৮২)। অবশ্য সতীর্থ-সহযাত্রী হিসেবে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত (১৯০৩-১৯৭৬), প্রেমেন্দ্র মিত্র (১৯০৪-১৯৮৮), অন্নদাশঙ্কর রায় (১৯০৪-২০০২), হুমায়ুন কবির (১৯০৬-১৯৬৯) এবং আরো কারো কারো নামও অনিবার্যভাবেই এসে যায়। এঁরা রবীন্দ্রপ্রভাববলয় ও পুরনো কাব্যচিন্তার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন।
তিরিশের প্রতিনিধিস্থানীয় এই ১১ জন কবির ১১৩টি চিঠি এখানে সংকলিত হলো। তিরিশের কবিদের সংখ্যায় এতো বেশি চিঠি একসঙ্গে এর আগে বোধকরি পত্র-পত্রিকায় কিংবা স্বতন্ত্র কোন বইয়ে ছাপা হয় নি। সংকলিত চিঠিগুলো নানা প্রসঙ্গে লেখা- এখানে যেমন সাহিত্যের বিষয় স্থান পেয়েছে, আছে ব্যক্তিজীবন কিংবা নিজস্ব ভাবনা-উপলব্ধির কথা, -পাশাপাশি ব্যক্তিগত প্রয়োজন অনুরোধ বা কুশলকামনা- ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের মতো সৌজন্য প্রকাশের অবলম্বনও হয়েছে এই পত্রগুচ্ছ।
কবিদের হস্তাক্ষরে পত্রাবলির সংকলন এই-ই প্রথম প্রকাশিত হলো। পত্রগুচ্ছের এই পা-ুলিপি-সংস্করণ-সংকলন-সম্পাদনা করেছেন ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী। পুরনো চিঠিপত্র সংগ্রহ ও প্রকাশে ডক্টর চৌধুরীর অনুরাগ ও সিদ্ধির পরিচয় মিলবে ইতঃপূর্বে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ও কাজী আবদুল ওদুদের পত্র-সংকলনে।
কবির অন্তরমহল : তিরিশের কবিদের পত্রাবলি-তে সংকলিত চিঠিপত্রে একটি বিশেষ কালের আধুনিক কবিদের অন্তর্জগতের বোধ বিশ্বাস, প্রকৃতি-প্রবণতা, চিন্তা- চেতনার অন্তরঙ্গ পরিচয় প্রতিফলিত।
সংগ্রহ-সংকলন-সম্পাদনা-ভূমিকা আবুল আহসান চৌধুরী
বাংলার লোকসংস্কৃতি-চর্চা ও লোক ঐতিহ্য-অম্বেষণে ক্লান্তিহীন এক শিল্প-শ্রমিকের নাম ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী। তাঁর জম্ম ‘লালনের দেশ’ কুষ্টিয়ার মজমপুরে, ১৩ জানুয়ারি ১৯৫৩। ফজলুল বারি চৌধুরী (১৯০৪-১৯৭৪) ও সালেহা খাতুন (১৯১৩-১৯৮৯) তাঁর জনক-জননী। পিতা ছিলেন সাহিত্যিক-সমাজসেবী-অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট। প্রফেসর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিএ (অনার্স) ও এমএ ডিগ্রি এবং পিএইচডি উপাধি অর্জন করেন। প্রায় বত্রিশ বছর অধ্যাপনা-পেশায় যুক্ত। কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বাংলা বিভাগের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে ঐ বিভাগের প্রফেসর।
ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী মূলত প্রাবন্ধিক ও গবেষক। সমাজমনস্ক ও ঐতিহ্যসন্ধানী। তাঁর চর্চা ও গবেষণার বিষয় ফোকলোর, ঊনিশ শতকের সমাজ ও সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব, সাময়িকপত্র, আধুনিক সাহিত্য ও আঞ্চলিক ইতিহাস। অনুসন্ধিৎসু এই গবেষক সাহিত্যের নানা দুষ্প্রাপ্য ও বিলুপ্তপ্রায় উপকরণ সংগ্রহ-উদ্ধার করে ব্যবহার করেছেন। তাঁর লালন সাঁই, কাঙাল হরিনাথ ও মীর মশাররফ হোসেন- বিষয়ক গবেষণা-কাজ দেশে-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। পাশাপাশি বাঙালি লেখকের দুষ্প্রাপ্য-মূল্যবান পত্র সংগ্রহ ও সংকলনে তাঁর আগ্রহের পরিচয় মিলবে বেশ কয়েকটি গ্রন্থে ও নানা পত্র-পত্রিকায়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৭০। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত ডক্টর চৌধুরীর প্রথম বই স্বদেশ আমার বাঙলা (১৯৭১, কলকাতা)। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : কুষ্টিয়ার বাউলসাধক (১৯৭৪), কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (১৯৮৮), জগদীশ গুপ্ত (১৯৮৮), লালন শাহ (১৯৯০), মনের মানুষের সন্ধানে (১৯৯৫), পাগলা কানাই (১৯৯৫), মীর মশাররফ হোসেন : সাহিত্যকর্ম ও সমাজচিন্তা (১৯৯৬), লোকসংস্কৃতি-বিবেচনা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (১৯৯৭), আব্বাসউদ্দিন (২০০২), অন্তরঙ্গ অন্নদাশঙ্কর (২০০৪), আলাপচারী আহমদ শরীফ (২০০৭)। সম্পাদিত গ্রন্থ : লালন স্মারকগ্রন্থ (১৯৭৪), ভাষা-আন্দোলনের দলিল (১৯৮৮), কাজী মোতাহার হোসেন রচনাবলী (১৯৯২), মহিন শাহের পদাবলী (১৯৯৩), প্রসঙ্গ হাসন রাজা (১৯৯৮), রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত পত্রাবলি (২০০০), লালনসমগ্র (২০০৯), রবীন্দ্রনাথ-সংগৃহীত লালনের গানের পা-ুলিপি (২০০৯)। ডক্টর চৌধুরী ফোকলোর-বিষয়ক গবেষণা-পত্রিকা লোকসাহিত্য পত্রিকা-রও (১৯৭৫-১৯৮৪) সম্পাদক ছিলেন।
আবুল আহসান চৌধুরী জন্ম ১৩ জানুয়ারি ১৯৫৩ কুষ্টিয়ার মজমপুরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ (অনার্স), এমএ ও পিএইচডি ৩২ বছর ধরে অধ্যাপনা পেশায় যুক্ত। বর্তমানে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। মূলত প্রাবন্ধিক ও গবেষক সমাজমনস্ক ও ঐতিহ্যসন্ধানী। অনুসন্ধিৎসু এই গবেষক সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা দুষ্প্রাপ্য ও অজ্ঞাত উপকরণ সংগ্রহ, উদ্ধার ও তা ব্যবহার করে থাকেন। তার লালন সাঁই, কাঙ্গাল হরিনাথ ও মীর মশাররফ হােসেন বিষয়ক গবেষণাকাজ দেশ-বিদেশে সমাদৃত। গবেষণায় বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৯ সালে । প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৭০।